ভারত ‘আগুন নিয়ে খেলছে’: হিনা রব্বানী

পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে “আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন” এবং “আগুন নিয়ে খেলা” বলে আখ্যায়িত করেছেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার। কাতারের রাজধানী দোহা থেকে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, “ভারত নিজেকে যেন বিচারক, জুরি এবং শাস্তিদাতা হিসেবে ভাবছে। তারা বুঝতে পারছে না যে এমন অপ্রত্যাশিত আগ্রাসন পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বার খুলে দিতে পারে। একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের ওপর সরাসরি হামলা চালানো একটি ভয়াবহ বার্তা দেয়—এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।”
ভারতীয় হামলার পটভূমি
সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে দেখা গেছে, ভারত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ইসলামাবাদ। এই হামলার জবাবে পাকিস্তানও আকাশসীমায় সক্রিয় হয়ে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে বলে জানানো হয়। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মিডিয়া উইং—আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)—এর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, “সব ভারতীয় বিমান আমাদের আকাশসীমার মধ্যেই গুলি করে নামানো হয়েছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে এবং প্রতিরক্ষায় কোনো ফাঁক নেই।”
জিও নিউজের বরাতে জানা গেছে, গুলি করে ভূপাতিত করা ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে রয়েছে তিনটি রাফাল, একটি মিগ-২৯ এবং একটি এসইউ-৩০ ফাইটার জেট।
হিনা রব্বানীর সতর্ক বার্তা
হিনা রব্বানী খার বলেন, “আমরা বহুবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ভারতের আগ্রাসন সম্পর্কে অবহিত করেছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততা ভারতে এই বার্তা দিয়েছে যে, তারা শাস্তি ছাড়াই আক্রমণ করতে পারে।”
তিনি যোগ করেন, “পাকিস্তান যথেষ্ট ধৈর্য ধরেছে, কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমরা পিছু হটবো না।”
সাক্ষাৎকারে হিনা রব্বানী আরও জানান, ভারতীয় হামলার কারণে পাকিস্তানে ফিরতে তিনি বিলম্বিত হচ্ছেন, কারণ হামলার কারণে বিমান চলাচল ব্যাহত হয়েছে। মধ্যরাতে চালানো এই হামলাকে তিনি অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন এবং একান্তই উসকানিমূলক বলেছেন।
কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক নিন্দা
এই হামলার ঘটনায় পাকিস্তান কূটনৈতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। ইসলামাবাদে অবস্থিত জাতিসংঘ দপ্তরে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে ওআইসি, চীন, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকেও ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়ে অবহিত করেছে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এক বিবৃতিতে বলেন, “এই হামলা শুধু পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ নয়, এটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধেও এক চরম হুমকি।”
তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা ভারতকে এই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখে।
এলওসি-তে উত্তেজনা
কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর বর্তমানে তীব্র গুলিবিনিময় চলছে বলে জানিয়েছেন আইএসপিআরের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, ভারতীয় সেনারা অনবরত সীমান্তে গুলি ছুঁড়ছে এবং পাকিস্তানও তার যথাযথ জবাব দিচ্ছে।
তিনি আরও জানান, “এলওসি-তে আমাদের বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে এবং যেকোনো ধরনের আগ্রাসনের জবাব দিতে প্রস্তুত।”
আন্তর্জাতিক আইনের প্রেক্ষাপট
আন্তর্জাতিক আইনে, একটি সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ডে তার সম্মতি ছাড়া সামরিক হামলা চালানো স্পষ্টতই অবৈধ। জাতিসংঘ সনদের ২(৪) ধারা অনুসারে, একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে পারে না, যদি না আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে তা জরুরি হয় বা নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন থাকে।
ভারতের দাবি অনুযায়ী, হামলাটি ছিল ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’। তবে এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি নয়াদিল্লি। পাকিস্তানের মতে, এটি ছিল নিছক একটি উসকানিমূলক হামলা, যার পেছনে রয়েছে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্য।
পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ গতিপথ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এমনিতেই উত্তেজনাপূর্ণ; সাম্প্রতিক এই হামলা তা আরও জটিল করে তুলেছে। দু’দেশই পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় সামান্য উসকানিও বড় ধরনের সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
হিনা রব্বানী খার বলেন, “এই আগ্রাসনের নেপথ্যে রাজনৈতিক অভিপ্রায় রয়েছে। ভারতের বর্তমান নেতৃত্ব অভ্যন্তরীণ সংকট আড়াল করতে বিদেশে উত্তেজনা তৈরি করছে।”
তিনি আরও বলেন, “এটা শুধুই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ।”
উপসংহার
বর্তমান পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক ভয়াবহ সংকেত বহন করছে। দুই প্রতিবেশী দেশ পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত, এবং উভয়পক্ষেরই জাতীয় গর্ব ও কূটনৈতিক অবস্থান ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হচ্ছে, দ্রুত হস্তক্ষেপ করে কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত করা।
হিনা রব্বানী খারের মন্তব্য এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ ভবিষ্যতের এক অনিশ্চিত পথে ইঙ্গিত দিচ্ছে—যেখানে সামান্য ভুল বোঝাবুঝিও এক ভয়াবহ সংঘাতে রূপ নিতে পারে।