পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন ফিলিস্তিনি লেখক মোসাব আবু তোহা

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে উঠে আসা কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক মোসাব আবু তোহা পেয়েছেন সাংবাদিকতার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সম্মান পুলিৎজার পুরস্কার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য নিউইয়র্কার-এ প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর জন্য তিনি মতামত বিভাগে ২০২৫ সালের এ পুরস্কার লাভ করেন।
এই সম্মাননা তাঁকে শুধু সাংবাদিকতার গৌরবই এনে দেয়নি, বরং গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া লাখো মানুষের যন্ত্রণাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছে। তবে এ অর্জনের পাশাপাশি আবু তোহা এখন রাজনৈতিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও রয়েছেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো তাঁকে বিতাড়নের দাবি তুলেছে।
গাজার ধ্বংস ও জীবনের গল্প নিয়ে আবু তোহার কলম
২০২৩ সালের গাজা যুদ্ধকালে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবন, হতাহত শিশু ও নাগরিকদের জীবনসংগ্রাম আবু তোহার প্রবন্ধগুলোতে উঠে এসেছে গভীর আবেগ, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ। তাঁর লেখার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো, যেখানে সাংবাদিকতা ও সাহিত্য মিলে একাত্ম হয়েছে।
প্রবন্ধগুলোতে তিনি লিখেছেন:
“গাজায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া প্রতিটি বাড়ি যেন এক একটি অ্যালবাম, যার পাতাগুলো ছবি দিয়ে নয়; বরং সত্যিকার মানুষ-মৃতদেহ দিয়ে ভরা।”
তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন নিজের হারানো আত্মীয়স্বজন, ধ্বংস হওয়া বসতবাড়ি, এবং নিজের সন্তানদের সঙ্গে স্কুলে আশ্রয় নেওয়ার করুণ স্মৃতি। একজন সাহিত্যিক হলেও তিনি এই লেখাগুলোতে নিজেকে শুধু একজন লেখক হিসেবে নয়, বরং একজন প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী, একজন স্বাক্ষরকারী ইতিহাসকার হিসেবেও উপস্থাপন করেছেন।
ইসরায়েলি নির্যাতন ও যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসন
২০২৩ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আবু তোহাকে গ্রেপ্তার করে এবং পরে তাঁকে মিসরে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করলেও নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। ডানপন্থী মার্কিন রাজনীতিবিদ ও কয়েকটি সংগঠন তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার দাবি তুলেছে।
এই চাপের কারণে গত কয়েক মাসে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন তিনি। তবু তাঁর লেখার সাহসিকতা ও মানবিক আবেদন পুলিৎজার বোর্ডকে এতটাই নাড়া দিয়েছে যে, তাঁকে দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পর্যায়ের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন সাংবাদিকতা পুরস্কার।
আলআরির স্মৃতিতে লেখা, পেছনে এক কবিতা
আবু তোহা সামাজিক মাধ্যমে পুলিৎজার বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন,
“কমেন্টারির জন্য আমি এইমাত্র পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছি। এটি আশার বার্তা হয়ে উঠুক। এটি একটি গল্প হোক।”
এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি হয়তো স্মরণ করেছেন আরেক ফিলিস্তিনি কবি রেফাত আলআরি-কে, যিনি ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। তাঁর লেখা শেষ কবিতার শিরোনাম ছিল: “যদি আমাকে মরতেই হয়, তবে এটি একটি গল্প হোক।” এই কবিতাটি গাজা যুদ্ধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
“আমি সেই দেশে, যে এই গণহত্যার পৃষ্ঠপোষক”—আবু তোহার হৃদয়বিদারক অভিব্যক্তি
আল–জাজিরার এক পডকাস্টে আবু তোহা বলেন:
“কল্পনা করুন, একসময় আপনি আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন ও সন্তানদের সঙ্গে গাজার একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। আপনি কাউকে রক্ষা করতে পারছেন না। তাঁদের কোনো খাবার, পানি কিংবা ওষুধ দিতে পারছেন না। অথচ এখন আপনি যুক্তরাষ্ট্রে, সেই দেশে আছেন যে দেশ এই গণহত্যার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এটি খুবই হৃদয়বিদারক।”
এই বক্তব্যে গাজার যুদ্ধাবস্থায় একজন সাধারণ ফিলিস্তিনির অসহায়তা, যন্ত্রণা ও দ্বন্দ্ব—সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে।
পুলিৎজার পেল অন্য যারা
আবু তোহা ছাড়াও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবার পুলিৎজার পেয়েছে। যেমন—
- রয়টার্স: যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণঘাতী মাদক ফেন্টানিল নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য
- ওয়াশিংটন পোস্ট: ব্রেকিং নিউজ ক্যাটাগরিতে
- নিউইয়র্ক টাইমস: চারটি বিভাগে পুলিৎজার জয়
পুলিৎজার পুরস্কার প্রথম দেওয়া হয় ১৯১৭ সালে। এটি সাংবাদিকতা, সাহিত্য, নাটক ও সংগীতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বোর্ড প্রতিবছর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে।
সাহস, স্মৃতি আর সত্যের জয়
মোসাব আবু তোহার বিজয় শুধু একজন লেখকের স্বীকৃতি নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে এক বিবেকের কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে মানুষের কান্না, ভাঙা দেয়ালের গল্প, এবং সেই চিত্র যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অনেকসময় চাপা পড়ে যায়।
এই পুলিৎজার তাঁর জন্য যেমন সম্মান, তেমনি গাজার লাখো নির্যাতিত মানুষের জীবনের দলিলও। মোসাব আবু তোহার এই সাফল্য যেন বিশ্বকে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়—একটি গল্প, একটি কলম, একটি সত্য—বিশ্ব রাজনীতির সব কোলাহলের চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে।