আসন্ন বাজেটে ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থা চান ব্যবসায়ীরা

২০২৫-২৬ অর্থবছরের আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো কর নীতিতে স্থিতিশীলতা, পূর্বানুমানযোগ্যতা এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গঠনের ওপর জোর দিয়েছে। একক ভ্যাট কাঠামো, কর প্রশাসনের আধুনিকায়ন, নন-ফাইলারদের আওতায় আনা এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতির দাবিতে রবিবার (৪ মে) ঢাকায় আয়োজিত এক সেমিনারে এ আহ্বান জানান বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
কঠিন হচ্ছে ব্যবসার পরিবেশ, দাবি ফরেন চেম্বারের সভাপতির
ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (FICCI)-এর সভাপতি জাবেদ আখতার বলেন, “বর্তমানে ব্যবসার জন্য একটি কঠিন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য অনিশ্চয়তা বাড়ছে।” তিনি কর প্রশাসনের কাঠামোগত সংস্কার, পূর্বানুমানযোগ্য করনীতি এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ কর আদায়ের পক্ষে মত দেন।
তিনি একক ভ্যাট কাঠামো চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, “বিভিন্ন হারে ভ্যাট প্রয়োগের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। একক হারে ভ্যাট ব্যবস্থা হলে তা ব্যবসা পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনার সুবিধা দেবে।”
জাবেদ আখতার আরও বলেন, “কাস্টমস বিভাগ কর সংগ্রহের মাধ্যমে নয় বরং ব্যবসায়িক পরিবেশ সহায়ক করার মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।”
নন-ফাইলারদের টার্গেট করবে এনবিআর
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান জানান, কর প্রশাসনের আওতার বাইরে থাকা নন-ফাইলারদের কর কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কমিশনার পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। তিনি বলেন, “আয়কর রিটার্ন দাখিল না করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে।”
তার ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় একই পরিমাণ রাজস্ব কর অব্যাহতির কারণে হারিয়ে যায়, যতটা সংগ্রহ করা হয়। তাই কর অব্যাহতি কমিয়ে রাজস্ব আহরণের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে এনবিআর।
তিনি আরও বলেন, “আগামী বাজেটে ব্যবসার সহজীকরণের উদ্যোগ থাকলেও রাজস্ব আহরণও যাতে বিঘ্ন না ঘটে, তা নিশ্চিত করা হবে।”
মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিয়োগের পতনে নীতিগত সংস্কারের আহ্বান
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কে এবং বিদেশি বিনিয়োগ ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করছে।” এই প্রেক্ষাপটে তিনি দ্রুত আর্থিক ও মুদ্রানীতি সংস্কারের দাবি জানান।
তিনি বলেন, “ঋণ পরিশোধের উচ্চ সুদ ও সার্ভিসিং খরচ উৎপাদনমুখী বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে।” পাশাপাশি দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ও নীতিমালার বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে মত দেন তিনি।
কর কাঠামোর আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল রূপান্তরের আহ্বান
স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির অংশীদার স্নেহাশীষ বড়ুয়া কর কাঠামোর আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, “আমরা ধীরে ধীরে পরিবর্তন চাচ্ছি না; চাই একটি দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন বাজেট যা কর আহরণ, ঋণের চাপ ও কর শৃঙ্খলায় মনোযোগ দেবে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত তুলনামূলকভাবে কম। একে বাড়াতে ভ্যাট আধুনিকায়ন এবং কর ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অটোমেশন অপরিহার্য।”
বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সুদৃঢ় নীতি চান ব্যবসায়ীরা
আইসিএবি প্রেসিডেন্ট মারিয়া হাওলাদার বলেন, “পূর্বাভাসযোগ্য কর নীতি ও ধারাবাহিকতা থাকলে ব্যবসায়ীরা পরিকল্পনা করতে পারবেন।” তিনি বলেন, “দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা যদি না ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা কঠিন হবে।”
তিনি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও টেকসই বিনিয়োগের ওপর জোর দেন।
বাংলাদেশ-জাপান বাণিজ্য সম্পর্কেও আশাবাদ
জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (JBCCI)-এর প্রেসিডেন্ট তারেক রফি ভূঁইয়া (জুন) বলেন, “বাজেটে ব্যবসা সহজীকরণ উদ্যোগ থাকলে তা বাংলাদেশ-জাপান অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করবে।”
বিশেষজ্ঞদের অভিমত: কর শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে সংস্কার প্রয়োজন
সেমিনারে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা একমত হন যে, রাজস্ব বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপায় হলো ব্যবসার পরিবেশ সহজ করা, কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা এবং যেসব করদাতা কর ফাঁকি দেন কিংবা রিটার্ন জমা দেন না, তাদের নজরদারির আওতায় আনা।
তারা বলেন, “সঠিক করনীতি ও বাস্তবায়ন থাকলে শুধু রাজস্ব নয়, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।”
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘিরে ব্যবসায়ী, গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা একটি সমন্বিত, স্বচ্ছ ও ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এনবিআর যেখানে রাজস্ব আদায়ের পরিধি বাড়াতে তৎপর, সেখানে ব্যবসায়ীরা চাইছেন পূর্বানুমানযোগ্য নীতি ও সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ। আসন্ন বাজেটে এই দুই পক্ষের ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে সরকার ও রাজস্ব বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।