অর্থনীতি

বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর একীভূতকরণে আট সদস্যের কমিটি

বাংলাদেশে বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম আরও সহজ ও সমন্বিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণের প্রস্তাব উঠেছে। এই প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত হয়েছে আট সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি। তবে এ প্রক্রিয়া ঘিরে উঠেছে নানামুখী আলোচনা ও আপত্তি—সরকারি মহলে যেমন, তেমনি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী মহলেও।

একীভূত করার প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানসমূহ

সরকার যেসব ছয়টি প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণের পরিকল্পনা করছে, সেগুলো হলো—

  • বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)
  • বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)
  • বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)
  • বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ)
  • পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষ (পিপিপিএ)
  • বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)

এই প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে পৃথকভাবে বিনিয়োগ অনুমোদন, নিবন্ধন, জমি বরাদ্দ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং পরিবেশ ছাড়পত্র ইত্যাদি বিষয়ে দায়িত্ব পালন করে থাকে। একীভূতকরণের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম একক ছাতার নিচে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কমিটির গঠন ও দায়িত্ব

গত ১৩ এপ্রিল বিডার গভর্নিং বোর্ডের সভায় একীভূতকরণের প্রস্তাব তোলা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিডা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরবর্তীতে ৩০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

আট সদস্যের কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।
কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন:

  • বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন
  • আন্তর্জাতিক বিষয়–সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী
  • বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর
  • মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া
  • জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান
  • অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিডার প্রস্তাব অনুযায়ী ছয়টি প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে সুপারিশ দেবে এই কমিটি।

একীভূতকরণ: সুবিধা না প্রতিবন্ধকতা?

সরকারি দপ্তরের ভেতরে ও বিনিয়োগকারী মহলে এই উদ্যোগকে ঘিরে দ্বিমত তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ী মহলের বড় একটি অংশ মনে করছে, এতগুলো পৃথক সংস্থার কারণে বিনিয়োগকারীদের অনেক ভোগান্তি হয়। প্রতিটি অনুমোদনের জন্য আলাদা দপ্তরে যেতে হয়, যার ফলে সময় ও খরচ দুটোই বাড়ে। একটি একীভূত সংস্থা হলে ‘ওয়ান-স্টপ সার্ভিস’ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, “এই একীভূতকরণ একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হতে পারে। এতে বিনিয়োগের পথ সহজ হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে দ্রুত। তবে বেপজার ভিন্নধর্মী কার্যক্রমের কারণে তাদের এ প্রক্রিয়া থেকে আলাদা রাখা উচিত।”

আপত্তি ও শঙ্কা

তবে বিপরীতমুখী মতও রয়েছে। বেজা, বেপজা ও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এসব সংস্থা পৃথক আইনের আওতায় পরিচালিত হয় এবং তাদের কাঠামো ও দক্ষতা ভিন্ন ভিন্ন। একীভূত করা মানে সব সমস্যার সমাধান নয়, বরং আরও জটিলতা তৈরি হতে পারে।

একাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারীও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। চীনের একটি বস্ত্র কোম্পানি, যারা উত্তরা ইপিজেডে ১৪ বছর ধরে ব্যবসা করছে, তারা চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে চিঠি দিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য, বেপজার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তাদের আকৃষ্ট করেছিল। এখন একীভূতকরণ হলে তাদের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ পরিকল্পনা অনিশ্চয়তায় পড়বে।

ঢাকা ইপিজেডে অবস্থান করা আরেকটি চীনা কোম্পানিও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে। তারা বলেছে, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই এ ধরনের উদ্যোগ বিনিয়োগ পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

বিকল্প প্রস্তাব: ওয়ান-স্টপ সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম

বেশ কয়েকটি সংস্থা মনে করছে, একীভূতকরণের পরিবর্তে একটি একক অনলাইন ওয়ান-স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। এতে করে প্রতিটি সংস্থা তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে বিনিয়োগকারীদের সব সেবা এক জায়গা থেকে দিতে পারবে।

বেজা ও বেপজার কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিডা নিবন্ধন দেয়, কিন্তু জমি বরাদ্দ দিতে পারে না। আবার বেপজা কেবল রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে। সুতরাং, সব সংস্থাকে একই ছাঁচে ফেলা বাস্তবসম্মত নয়।”

ভবিষ্যৎ করণীয়

কমিটি এখন তাদের দায়িত্ব পালন করছে। তারা মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে প্রতিবেদন দেবে। তারপর সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে—সংস্থাগুলোকে একীভূত করা হবে, না কি সমন্বিত ডিজিটাল সেবা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হবে।

সরকারি সূত্র বলছে, মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের জটিলতা দূর করে দ্রুত, স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য সেবা নিশ্চিত করা। তবে এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তিযুক্ত পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামত গ্রহণ করাটাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button