অর্থনীতি

শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা

বাংলাদেশের শিল্পখাত নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার এবং জ্বালানি সংকটের মতো সমস্যার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা উদ্যোক্তাদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় ৩ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা রফতানি বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। পাশাপাশি, নতুন ও পুরানো গ্যাস সংযোগে ভিন্ন ভিন্ন দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত অভ্যন্তরীণ বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করবে বলে শিল্পোদ্যোক্তারা মনে করছেন। এদিকে, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বিইআরসির দুর্নীতি দমন না করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন।

শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পখাতে গ্যাসের দাম এক লাফে ১৫০ থেকে ১৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই দাম বৃদ্ধির ফলে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ, বাড়তি খরচের বোঝা তাদের ওপর চাপলেও প্রতিশ্রুত গ্যাস সরবরাহের কোনো উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, আবার গ্যাসের অভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে। এতে আমাদের খরচ দুদিক থেকেই বাড়ছে।”

এর মধ্যেই গত ১৩ এপ্রিল বিইআরসি শিল্পখাতে নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুরানো সংযোগের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে এই বাড়তি দাম প্রযোজ্য হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফতুল্লা অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, “এই দাম বৃদ্ধি নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। উৎপাদন খরচ ৩ থেকে ৫ শতাংশ বাড়বে, যা রফতানি বাজারে আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করবে।”

রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। এই খাত থেকে দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে। কিন্তু গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলে এই খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে। বিশ্ববাজারে ভিয়েতনাম, ভারত, এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বাড়লে বাংলাদেশের পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে, ফলে ক্রেতারা অন্য দেশের দিকে ঝুঁকতে পারেন।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-এর সহসভাপতি সালেউদ জামান খান বলেন, “বিশ্ববাজারে এলএনজি এবং তেলের দাম কমে গেছে। এমন সময়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা অযৌক্তিক। এতে নতুন কারখানা স্থাপন বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিদ্যমান কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে।” তিনি আরও বলেন, “ব্যাংকের সুদের হার ইতোমধ্যেই বেশি। এর ওপর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি শিল্পখাতের জন্য মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে।”

অভ্যন্তরীণ বাজারে অসম প্রতিযোগিতার শঙ্কা

নতুন ও পুরানো গ্যাস সংযোগে ভিন্ন ভিন্ন দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত অভ্যন্তরীণ বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করতে পারে। পুরানো কারখানাগুলো তুলনামূলক কম দামে গ্যাস পাবে, যেখানে নতুন কারখানাগুলোকে বাড়তি দাম দিতে হবে। এতে নতুন উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন। ফজলে শামীম এহসান বলেন, “একেক কারখানায় গ্যাসের দাম একেক রকম হলে অভ্যন্তরীণ বাজারে অরাজকতা সৃষ্টি হবে। এটি শিল্পখাতের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর।”

বিইআরসির দুর্নীতি ও জ্বালানি নীতি

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বিইআরসির দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, “বিইআরসির মধ্যে দুর্নীতি দমন না করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত শিল্পখাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি মানে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, যা শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা নষ্ট করবে।” তিনি আরও বলেন, “আমদানি নির্ভর জ্বালানি থেকে বেরিয়ে এসে স্থানীয়ভাবে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে। বর্তমানে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, ভর্তুকি বাড়ছে, এবং গ্যাসের ঘাটতি ও লোডশেডিংও বাড়ছে। এটি শিল্পখাতের জন্য ম সম্প্রতি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা। শিল্পখাতে গ্যাস সংযোগ সমস্যা এবং বিইআরসির দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।”

সমাধানের পথ

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিল্পবান্ধব জ্বালানি নীতি প্রণয়ন এবং স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। ড. শামসুল আলম পরামর্শ দিয়েছেন, “সরকারকে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে হবে। এছাড়া বিইআরসির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “শিল্পখাতের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল জ্বালানি সরবরাহ এবং যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ অপরিহার্য।”

এছাড়া, শিল্পোদ্যোক্তারা সরকারের কাছে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি এবং দাম স্থিতিশীল রাখার দাবি জানিয়েছেন। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “আমরা শুধু নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চাই। দাম বৃদ্ধি করে শিল্পখাতকে চাপে ফেলা উচিত নয়।”

উপসংহার

শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। বিইআরসির দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পবান্ধব জ্বালানি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। সরকারের কাছে শিল্পোদ্যোক্তা এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের দাবি, গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি এবং দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। অন্যথায়, বাংলাদেশের শিল্পখাত গভীর সংকটের মুখে পড়তে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button