গাজায় হামলার পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা ইসরায়েলের

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যে এবার হামলার পরিধি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনায় নেমেছে দখলদার ইসরায়েল। নতুন করে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানোর অংশ হিসেবে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী ব্যাপক হারে রিজার্ভ সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
শুক্রবার (২ মে) ইসরায়েলের একাধিক জাতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, গাজায় সেনা মোতায়েন কমে আসা, জিম্মিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ায় এই পদক্ষেপ নিচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন কট্টর ডানপন্থী সরকার।
সংবাদমাধ্যম ইয়েদিয়ুথ আহরোনোথ জানায়, শুক্রবার রাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দেশটির উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা। বৈঠকে গাজায় সামরিক অভিযান আরও জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানানো হয়।
গাজা যুদ্ধের ‘প্রধান লক্ষ্য’
বৈঠকের আগের দিন বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, ‘গাজা যুদ্ধে জয়লাভই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। জিম্মিদের মুক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ের বিবেচনায় আছে।’
নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যের পরই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উদ্বেগ বাড়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জিম্মিদের মুক্তির বিষয়টি পেছনে ফেলে বড় হামলার ঘোষণা আসতে পারে—এমন ইঙ্গিতই দিয়েছে ইসরায়েল।
একই সঙ্গে বেশ কয়েকজন রিজার্ভ সেনা কর্মকর্তা তাদের ইউনিটের সদস্যদের ‘হঠাৎ ডাক’ পাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এটা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, বড় হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
হামাসের প্রস্তাব ও ইসরায়েলের প্রত্যাখ্যান
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাস সম্প্রতি ইসরায়েলকে একটি শান্তিপূর্ণ প্রস্তাব দেয়। এতে বলা হয়, স্থায়ী যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে গাজায় আটক থাকা সব ইসরায়েলি জিম্মিকে একসঙ্গে ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু নেতানিয়াহুর সরকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
তারা বলছে, হামাসের এই প্রস্তাব কৌশলী এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলের অবস্থান দুর্বল করতে পারে। তাই যেকোনো শান্তি প্রস্তাব গ্রহণের আগে ‘সম্পূর্ণ সামরিক বিজয়’ অর্জন করতে চায় ইসরায়েল।
রিজার্ভ সেনা মোতায়েনের পেছনের যুক্তি
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাযথ মূল্যায়ন ও দায়িত্বশীলতার ভিত্তিতে’ রিজার্ভ সেনা ডেকে পাঠানো হবে।
এছাড়া সেনা সংখ্যায় ঘাটতির বিষয়টি এখন স্পষ্ট। দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে অনেক সেনা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি জনসাধারণের মধ্যেও যুদ্ধে ক্লান্তি ও বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন সেনা মোতায়েনের উদ্যোগ যুদ্ধকে নতুন মাত্রা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গাজার বাস্তব চিত্র
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় যে ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু করেছে ইসরায়েল, তা এখনও চলছে। ফিলিস্তিনে প্রতিদিন অসংখ্য সাধারণ মানুষ বোমা হামলার শিকার হচ্ছেন।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু।
গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, খাদ্য, পানি ও ওষুধের ঘাটতি চরমে। হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন।
গত জানুয়ারিতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু পবিত্র রমজান মাসে ইসরায়েল সেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে আবারও সাধারণ জনগণের ওপর গণহত্যা চালায়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
ইসরায়েলের এ পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, জিম্মিদের উদ্ধারের নামে ইসরায়েল মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে পুরো গাজা ধ্বংস করে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েল গাজায় স্থল অভিযান পুনরায় শুরু করতে পারে। এতে বহু নিরীহ মানুষের প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়বে।
তারা আরও বলছেন, যদি ইসরায়েল বড় পরিসরে রিজার্ভ সেনা মোতায়েন করে তাহলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য তা ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে।
উপসংহার
ইসরায়েলের গাজা আগ্রাসন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিচ্ছে। রিজার্ভ সেনা মোতায়েন এবং হামলার পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যুদ্ধকে আরও রক্তক্ষয়ী করে তুলবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত—এই মানবিক সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখা। যুদ্ধ নয়, শান্তিই হতে হবে এই সংকট সমাধানের প্রধান পথ।