অর্থনীতি

কর ও কাস্টমস ক্যাডারের আন্দোলনে ঢুকে পড়ছে ফ্যাসিস্টের দোসররা

কর ও কাস্টমস ক্যাডারের যৌক্তিক ও পেশাদার দাবির ভিত্তিতে চলমান আন্দোলনের মধ্যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত একটি গোষ্ঠী। সূত্র মতে, এই গোষ্ঠী ফ্যাসিস্ট চরিত্রের এবং আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট বলে পরিচিত। তারা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে শুধু আন্দোলনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং সরকারের রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়াকেও ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

চলমান আন্দোলনটি মূলত এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) ভেঙে দুইটি নতুন বিভাগ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে কর ও কাস্টমস ক্যাডারের জন্য দুটি সিনিয়র সচিব পদ সংরক্ষণের দাবিতে পরিচালিত হচ্ছে। কারণ এই দুটি ক্যাডার অত্যন্ত বিশেষায়িত, যাদের পেশাগত দক্ষতা এবং দীর্ঘদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া এ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন কার্যকর হয় না। এ প্রেক্ষিতেই ক্যাডারভিত্তিক ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সক্রিয় হয়েছেন কর্মকর্তারা।

তবে এই প্রক্রিয়ার মাঝখানে ঢুকে পড়েছে এমন একটি গোষ্ঠী যারা আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে নেওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে আড়াল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক কর কমিশনার একেএম বোরহান উদ্দিন, যিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে অতীতে দলীয় প্রভাব খাটানো, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। যদিও তিনি দীর্ঘদিন আড়ালে ছিলেন, এখন আবার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়ে মাঠে নেমেছেন এবং সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন হাইজ্যাকের কৌশলে নেমেছেন।

যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলা কয়েকজন কর্মকর্তার দাবি, বুধবার সন্ধ্যায় এনবিআর ভবনে অনুষ্ঠিত জরুরি বৈঠকে এই গোষ্ঠীর কয়েকজন ঢুকে নেতৃত্ব গ্রহণের অপচেষ্টা করেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত কর্মকর্তারা তাদের প্রতিহত করেন। কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, তারা এখন আরও বেশি সজাগ ও সতর্ক এবং ভবিষ্যতে এমন কারও প্রবেশ ঠেকাতে প্রশাসনের সহায়তা নেবেন। এ সময় তারা উল্লেখ করেন, ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন ছদ্মবেশে যেমন “রিকশা লীগ”, “আনসার লীগ” কিংবা “সিএনজি লীগ”-এর নামে এই গোষ্ঠী সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে।

এদিকে, আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন যে, তাদের আন্দোলন একান্তই পেশাগত স্বার্থে এবং জনস্বার্থে পরিচালিত। রাজস্ব আদায়ে তাঁদের দক্ষতা ও নিষ্ঠা বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং আরও সচেষ্ট হয়েছেন তাঁরা। তাদের মতে, এ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা কোনো নির্দিষ্ট ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, বরং সিস্টেমেটিক ও ন্যায্য ভিত্তিতে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছেন। বিশেষায়িত এই ক্যাডারে সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগের দাবি তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতেই তুলে ধরা হচ্ছে।

তারা আরও বলেন, অতীতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে এনবিআর চেয়ারম্যান নিয়োগের ফলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা দেখা গেছে। কারণ প্রশাসন ক্যাডার থেকে আগত ব্যক্তিরা এনবিআর-এর কার্যক্রম বুঝতেই সময় নিয়েছেন ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। এর ফলে বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন কিংবা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিপরীতে, কর ও কাস্টমস ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে অনেক আগে থেকেই অনুশীলিত ও অভিজ্ঞ, যারা মাঠ পর্যায়ে কাজের মাধ্যমে সমস্যার শিকড় ও সমাধান উভয়ই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।

এ প্রসঙ্গে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বলেন, “আমরা চাই, যে অধ্যাদেশ আইনি ভেটিং হয়ে উপদেষ্টা পরিষদে যাবে, সেখানে আমাদের দাবির প্রতিফলন থাকুক। কারণ, এখন যদি এটি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আর কখনো ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। এক্ষেত্রে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা ও সমর্থন প্রয়োজন।”

অন্যদিকে, আন্দোলনের আড়ালে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ে কর ও কাস্টমস ক্যাডারের মধ্যম ও জুনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তারা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একাধিক সূত্র জানায়, এনবিআরের সিনিয়র কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এই গোষ্ঠীকে গোপনে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান, যা আন্দোলনকারীদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। তারা বলেন, “আমরা কোনো ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থ চাই না। চাই পেশাদারিত্ব, স্বচ্ছতা ও ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ।”

এরই মধ্যে কর ক্যাডার ও কাস্টমস ক্যাডার উভয় অ্যাসোসিয়েশন পৃথক জরুরি সাধারণ সভার আয়োজন করেছে। বিসিএস কাস্টমস ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সভা ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আগামীকাল শনিবার বিকেলে বিসিএস কর ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন এনবিআর ভবনে তাদের সাধারণ সভা করবে। এই সভাগুলোতে আন্দোলনের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ ছাড়াও বিভ্রান্তিকর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে।

অতএব, একদিকে যখন কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে ন্যায্য অধিকার আদায়ে নিয়োজিত, অন্যদিকে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই ন্যায্য আন্দোলনকে রাজনৈতিক মোড় দিয়ে প্রভাবিত করতে মরিয়া। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নীতিনির্ধারকদের দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো প্রয়োজন, যাতে পেশাদার ক্যাডারের সম্মান ও দেশের রাজস্ব ব্যবস্থা উভয়ই সুরক্ষিত থাকে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button