বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে: জাতিসংঘ

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। শুক্রবার (২ এপ্রিল) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এফএও উল্লেখ করেছে, গম, চাল, মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে খাদ্য মূল্যসূচক ১ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে খাদ্য মূল্যসূচক ১২৮.৩ পয়েন্টে পৌঁছেছে, যা মার্চ মাসে ছিল ১২৭.১ পয়েন্ট। অর্থাৎ, মাসিক ভিত্তিতে সূচকটি ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, ২০২২ সালের মার্চে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর খাদ্য মূল্যসূচক যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তার তুলনায় বর্তমান সূচক এখনো ১৯.৯ শতাংশ কম রয়েছে।
শস্যের দামে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি
এফএও’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার গম রপ্তানি হ্রাস পাওয়ায় সরবরাহ সংকুচিত হয়েছে, যা গমের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এছাড়া, বিশ্বব্যাপী চালের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে চালের দামও বেড়েছে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রে ভুট্টার মজুত কমে যাওয়ায় শস্য মূল্যসূচক সামগ্রিকভাবে ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় এই সূচক ০.৫ শতাংশ কম রয়েছে। শস্যের দাম বৃদ্ধির এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
শস্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে বিশ্ববাজারে সরবরাহ শৃঙ্খলের বিঘ্ন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের গম রপ্তানির একটি বড় অংশ সরবরাহ করে। তাদের মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে এই সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে, যা বিশ্ববাজারে গমের দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, এশিয়ার কয়েকটি দেশে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে চাল রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের ফলে চালের দামও বেড়েছে।
মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি
এপ্রিল মাসে মাংস মূল্যসূচক ৩.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির পেছনে শুকরের মাংসের দামে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং গরুর মাংসের আমদানি চাহিদা বৃদ্ধি অন্যতম কারণ। বিশেষ করে, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গরুর মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এর দাম বেড়েছে। এছাড়া, শুকরের মাংসের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে সরবরাহ কমে যাওয়ায় এর দামও বেড়েছে।
দুগ্ধজাত পণ্যের মূল্যসূচক এপ্রিল মাসে ২.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এক বছরে এই সূচক ২২.৯ শতাংশ বেড়েছে, যা উদ্বেগজনক। ইউরোপে মাখনের মজুত হ্রাস পাওয়ায় এই পণ্যের দাম রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, শ্রম ঘাটতি, এবং জ্বালানি খরচ বৃদ্ধিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া, বিশ্বের অনেক দেশে দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরবরাহের ওপর চাপ পড়েছে।
উদ্ভিজ্জ তেল ও চিনির দামে হ্রাস
সব খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলেও, উদ্ভিজ্জ তেল এবং চিনির দাম কিছুটা কমেছে। পাম তেলের দাম হ্রাস পাওয়ায় উদ্ভিজ্জ তেলের মূল্যসূচক ২.৩ শতাংশ কমেছে। এই হ্রাসের পেছনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাম তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানি বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে, বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তার প্রভাবে চিনির দাম ৩.৫ শতাংশ কমেছে। চিনির দাম কমার পেছনে ব্রাজিলের মতো দেশগুলোতে চিনির উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বৃদ্ধিও কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস
এফএও’র পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী গম উৎপাদন ৭৯৫ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছাবে, যা ২০২৪ সালের সমান। তবে, মোট শস্য উৎপাদনের পূর্বাভাস সামান্য কমিয়ে ২.৮৪৮ বিলিয়ন টন ধরা হয়েছে। এই পূর্বাভাসের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তার প্রভাব বিবেচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে, আবহাওয়ার অনিয়মিত আচরণ এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো শস্য উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব
বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি খাদ্য নিরাপত্তার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে পরিবারের বেশিরভাগ আয় খাদ্য ক্রয়ে ব্যয় হয়, এই দাম বৃদ্ধি জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। এছাড়া, খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির হার বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা অর্থনীতির অন্যান্য খাতের ওপরও প্রভাব ফেলছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালী করা, এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তার।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের মতো আমদানি-নির্ভর দেশগুলোর জন্য খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। দেশটি গম, চাল, এবং ভোজ্যতেলের একটি বড় অংশ আমদানি করে। বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি বাংলাদেশের বাজারেও প্রভাব ফেলছে। ফলে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি প্রদান, আমদানি শুল্ক হ্রাস, এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই প্রভাব কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।
উপসংহার
বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এফএও’র প্রতিবেদন এই সমস্যার গভীরতা এবং এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। বিশ্ববাজারে শস্য, মাংস, এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বৃদ্ধি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। তবে, উদ্ভিজ্জ তেল এবং চিনির দাম হ্রাস কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ শৃঙ্খল উন্নত করা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি।