অর্থনীতির জন্য আগামী ৭ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: প্রেস সচিব

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আগামী সাত মাস যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা গভীর ও সুদূরপ্রসারীভাবে তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে দেওয়া এক বিশ্লেষণধর্মী পোস্টে তিনি বলেন, এই সময়কালটি দেশের জন্য সম্ভাবনার নতুন জানালা খুলে দিতে পারে—তেমনি যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে তা ব্যর্থতার দিকেও নিয়ে যেতে পারে।
শফিকুল আলম লেখেন, ”আগামী সাত মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টা বাংলাদেশকে গড়ে তুলতেও পারে, আবার ব্যর্থ করতেও পারে।” তাঁর এ বক্তব্য শুধু ভবিষ্যতের এক সতর্ক বার্তা নয়, বরং বর্তমান বাস্তবতা ও প্রস্তুতির গুরুত্বকেও নতুনভাবে সামনে আনে।
চট্টগ্রাম বন্দরের রূপান্তর পরিকল্পনা
পোস্টে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপ হচ্ছে দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের সক্ষমতা ছয় গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা। এটি কেবল একটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প নয়; বরং একটি অর্থনৈতিক রূপান্তরের রূপরেখা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বন্দর পরিচালকদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব অপরিহার্য বলে মনে করেন তিনি।
শফিকুল আলমের ভাষায়, “শীর্ষ বৈশ্বিক অংশীদারদের যুক্ত না করলে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে সফল হলে এটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের কাছে একটি শক্ত বার্তা দেবে যে বাংলাদেশ এখন ব্যবসার জন্য প্রস্তুত ও উন্মুক্ত।”
এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বন্দরের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানি বাজারে পিছিয়ে থাকতে হয়েছে। এ প্রকল্প যদি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা শিল্পায়ন, রপ্তানি, কর্মসংস্থান এবং বিদেশি বিনিয়োগে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
প্রেস সচিব তাঁর পোস্টে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি সুস্পষ্ট চিত্রও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছিল এবং যা পরবর্তীতে ডব্লিউটিও-র মাধ্যমে কাঠামোবদ্ধ হয়, তা এখন বিলীন হওয়ার পথে। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা ভিন্ন, নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি লিখেছেন, “নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল বা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস পড়লেই বোঝা যায়, পুরোনো অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা আর নেই। এখন নতুন খেলোয়াড়দের উত্থানের সময়।”
শফিকুল আলম আরও বলেন, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো—যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া—যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বাজারমুখী রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনও সেই পথেই এগোচ্ছে। তবে দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘদিন পিছিয়ে ছিল।
এই প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “এখন হয়তো অবশেষে বাংলাদেশের সময় এসেছে। আমরা কি এই মুহূর্তকে কাজে লাগাতে পারব?”
এই বক্তব্যে একদিকে যেমন আশার আলো ফুটে ওঠে, তেমনি রাজনীতি ও প্রশাসনিক প্রস্তুতির গুরুত্বও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রাসঙ্গিক নীতি, দক্ষতা ও অবকাঠামো থাকা জরুরি।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ: লজিস্টিকস
শফিকুল আলম পোস্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, “লজিস্টিক-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জই হতে পারে সবচেয়ে বড় বাধা।” একটি উৎপাদনমুখী অর্থনীতির জন্য কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা থাকা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, “বৃহৎ পরিমাণ পণ্য দ্রুত ও কার্যকরভাবে পরিবহনের সক্ষমতা শিগগিরই পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ যে একটি উৎপাদনশীল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়, সে আকাঙ্ক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে।”
বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, দেশে এখনও রেল, সড়ক ও জলপথে একটি সমন্বিত মালবাহী পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি। চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও মংলা, পায়রা ও আন্তঃদেশীয় সংযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া টেকসই প্রবৃদ্ধি অসম্ভব।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা অপরিহার্য
এই সাত মাস শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য নয়, বরং একটি পরিপক্ব রাজনৈতিক পরিবেশ ও নীতিনির্ধারণী স্বচ্ছতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়ী মহল দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, নীতির স্থায়িত্ব এবং প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাস ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ানো কঠিন।
প্রেস সচিবের বক্তব্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্বশীল ভূমিকার ইঙ্গিতও স্পষ্ট। এই সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে রাজনৈতিক ঐকমত্য, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
উপসংহার
আগামী সাত মাস বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি সময়কাল নয়, বরং এটি একটি সম্ভাবনার জানালা—যা অর্থনৈতিক উত্তরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দরকার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব, কার্যকর লজিস্টিকস, এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সময়োপযোগীভাবে যে সতর্কবার্তা ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তা নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।