পুকুরে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া

ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলায় এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় পুকুরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে দুই শিশু। শুক্রবার (২ মে) দুপুরে উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী মিঝি বাড়িতে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। নিহত শিশু দুটি হলো—নাফিজ (৯) ও ইয়াছিন (৭)। তারা একই বাড়ির বাসিন্দা এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
এই ঘটনায় পুরো গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ও একত্রে বেড়ে ওঠা এই দুই শিশুর এমন অকাল মৃত্যুতে পরিবার, প্রতিবেশী এবং এলাকাবাসী সবাই শোকাহত ও বাকরুদ্ধ।
নিহত শিশুর পরিচয়
- নাফিজ (৯): পিতা মো. নেজাম, চণ্ডীপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী মিঝি বাড়ি।
- ইয়াছিন (৭): পিতা মো. সাইফুল ইসলাম, একই বাড়ির আরেক সদস্য।
দুই শিশুই স্থানীয় একটি কওমি মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তারা ছিল সহপাঠী, খেলার সাথী এবং আত্মীয়—একসাথে চলাফেরা করত, খেলত, পড়ত।
ঘটনার বিবরণ: জুমার নামাজের সময় ঘটে দুর্ঘটনা
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ ফয়সাল জানান, শুক্রবার জুমার নামাজের সময় পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মসজিদে চলে যান। ওই সময় বাড়ির সামনে থাকা পুকুরে গোসল করতে নামে নাফিজ ও ইয়াছিন।
কিছু সময় পর তাদের কোনো সাড়া না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। পুকুরঘাটে তাদের জুতো ও কাপড় পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ বাড়ে। পরে স্থানীয়রা পুকুরে নেমে খোঁজ শুরু করেন।
দুই শিশুকে উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
থানা-পুলিশের বক্তব্য
ঘটনার বিষয়ে দাগনভূঞা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ওয়াহিদ পারভেজ বলেন:
“আমরা শিশু দুটির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। ঘটনা জানার পর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। প্রয়োজনীয় আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।”
একই বাড়ির দুই শিশুর মৃত্যু: শোকের ছায়া ও কান্নার রোল
একই পরিবারের দুটি শিশুর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে পুরো গ্রামে চলছে শোকাবহ পরিবেশ। শুক্রবারের জুমার নামাজের পর থেকেই চণ্ডীপুর মিঝি বাড়িতে শোকাহত স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
স্থানীয় ইউপি সদস্য থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। অনেকে শিশুদের প্রতি নজরদারির গুরুত্ব তুলে ধরে অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর জাতীয় চিত্র
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৪ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, যা বিশ্বে অন্যতম বেশি। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে পুকুর, খাল, ডোবা ইত্যাদি খোলা জলাশয়ের পাশে শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো:
- পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব
- নিরাপদ গোসলের জায়গার অভাব
- শিশুদের সাঁতার না জানা
- ব্যস্ত সময়ে অভিভাবকদের অমনোযোগ
এই ঘটনায়ও একই বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে অভিভাবকেরা জুমার নামাজে ছিলেন এবং শিশু দুটি একা পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিল।
প্রতিরোধের উপায় ও জনসচেতনতার প্রয়োজনীয়তা
এই ধরণের মর্মান্তিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
✅ শিশুদের জন্য গোসলের নির্ধারিত নিরাপদ জায়গা নিশ্চিত করা
✅ পরিবারের একজন সদস্যকে সবসময় শিশুদের সাথে রাখার ব্যবস্থা করা
✅ গ্রামে শিশু সুরক্ষা বিষয়ে কমিউনিটি সচেতনতা বৃদ্ধি
✅ প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের সাঁতার শেখানো
✅ পুকুর বা জলাশয়ের চারপাশে সতর্কতামূলক চিহ্ন ও বাঁশের বেড়া দেওয়া
শিশুমৃত্যু যেন আর না হয় এমনভাবে
নাফিজ ও ইয়াছিনের এই অকাল মৃত্যু আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত করে। একইসঙ্গে এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের সামষ্টিক দায়িত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও তাদের আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, তবে এই ট্র্যাজেডি যেন আর কোনো পরিবারে না ঘটে, সেই জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজের সবাইকে।