দাবানল ও ধূলিঝড়ের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত ইসরায়েল, জরুরি সতর্কতা জারি

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র ইসরায়েল বর্তমানে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক সংকটের মুখোমুখি। দেশটির দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি শুরু হয়েছে প্রচণ্ড ধূলিঝড়। ফলে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, বাড়ানো হয়েছে সতর্কতা, স্থগিত করা হয়েছে বহু ফ্লাইট এবং জরুরি উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে দেশটির প্রশাসন।
ইসরায়েলি আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি সপ্তাহে দেশজুড়ে অত্যধিক খরার পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং বাতাসে ধুলোর মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে নেগেভ মরুভূমি এলাকা, বিয়ারশেবা, আশদোদ, আশকেলন, এমনকি তেল আবিবের দক্ষিণাঞ্চলেও এই ধূলিঝড়ের প্রভাব পড়েছে।
দাবানলে দগ্ধ বনাঞ্চল, আতঙ্কে স্থানীয় বাসিন্দারা
ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে দাবানল সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন বনাঞ্চলে আগুন লেগে ছড়িয়ে পড়েছে হাজার হাজার একর এলাকায়। সিএনএন, রয়টার্স এবং স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, তীব্র খরা এবং উত্তপ্ত বাতাস দাবানল ছড়ানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।
ইসরায়েলের দমকল বিভাগ জানায়, এখন পর্যন্ত শতাধিক দমকল ইউনিট দাবানল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। আকাশপথে পানি ছিটানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে স্পেশাল ফায়ার-ফাইটিং প্লেন। তবে বাতাসের গতি বেশি থাকায় আগুনের গতিপথ বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে এবং নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ছে।
ইসরায়েলি জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের সতর্ক করে বলেছে, যারা আগুনের কাছাকাছি এলাকায় আছেন, তারা যেন দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যান। ফায়ার সার্ভিসের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, “আমরা দিন-রাত কাজ করছি। এই দাবানল এখনই থামার সম্ভাবনা কম। পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে পারে।”
ধূলিঝড়ে আচ্ছন্ন রাজধানী, ফ্লাইট বাতিল ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি
একই সময়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে বইছে তীব্র ধূলিঝড়। এ ধূলিঝড় মূলত আরব মরুভূমি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়ে ইসরায়েল অতিক্রম করছে। এতে বাতাসে ধুলোর মাত্রা PM10 এবং PM2.5 মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তেল আবিব, হাইফা ও জেরুজালেমে মানুষ মুখে মাস্ক পরিধান করছে এবং জনসাধারণকে বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য এই ধূলিঝড় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
তেল আবিবের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। আকাশপথে দৃশ্যমানতা অনেক কমে যাওয়ায় পাইলটরা নিরাপদ অবতরণ করতে পারছেন না।
একাধিক অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি
ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় আংশিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। জনসাধারণকে বলা হয়েছে, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হতে এবং সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করতে। স্কুল, কলেজ ও অফিসগুলোতে কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) এবং বেসামরিক উদ্ধার ইউনিট একসঙ্গে কাজ করছে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দমকল, স্বাস্থ্য বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সদস্যরাও।
এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, “এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা জনগণের পাশে আছি এবং প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিচ্ছি।”
আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রভাব কি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলে এই ধরনের দাবানল ও ধূলিঝড় খুব একটা বিরল নয়, তবে এবারের ঘটনা অনেক বেশি ব্যাপক। তীব্র তাপদাহ ও দীর্ঘস্থায়ী খরা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। অনেকেই মনে করছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব দুর্যোগ বাড়ছে।
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. এলিয়ানা লেভিন বলেন, “ইসরায়েল এখন জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব অনুভব করছে। দাবানল ও ধূলিঝড় প্রমাণ করছে আমাদের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
ফিলিস্তিনের কিছু অংশেও প্রভাব পড়েছে
ইসরায়েলের পাশাপাশি পাশ্ববর্তী গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরেও ধূলিঝড়ের প্রভাব পড়েছে। গাজার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, অনেক শিশু ও বৃদ্ধ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও তাদের জনগণকে সতর্ক থাকতে বলেছে এবং সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সতর্কতা
ইতিমধ্যে ইউরোপের কয়েকটি দেশ এবং জাতিসংঘ ইসরায়েলকে সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। ইউএনডিপি, ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি এবং রেডক্রসসহ অনেক সংস্থা প্রস্তুত রয়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়ের মোকাবেলায়।
তবে এখনো পর্যন্ত ইসরায়েল কোনো আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণের ঘোষণা দেয়নি। তারা বলছে, আপাতত দেশের নিজস্ব সম্পদ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে।
কী বার্তা দিচ্ছে এই সংকট?
ইসরায়েলে চলমান দাবানল ও ধূলিঝড় আবারও মনে করিয়ে দেয় জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন আর শুধু পরিবেশগত ইস্যু নয়, এটি মানবিক, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা সংকটেও রূপ নিচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, সামরিক শক্তিশালী রাষ্ট্র ইসরায়েলও এর বিরুদ্ধে রক্ষা পাচ্ছে না।
বিশ্ববাসীর এখন প্রয়োজন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ। না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হতে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়তে পারে।