আরব সাগরে মার্কিন রণতরীতে হুতি ড্রোন হামলা

হুতিদের দাবি: ‘ইউএসএস কার্ল ভিনসন’-এ সরাসরি হামলা
আরব সাগরের মাঝখানে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস কার্ল ভিনসন’-এ ড্রোন হামলার দাবি করেছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর জানায়, হুতিদের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি বুধবার এক ঘোষণায় বলেন, “আমাদের ড্রোন ইউনিট আরব সাগরে থাকা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও বিমানবাহী রণতরীর উপর সফলভাবে একাধিক হামলা চালিয়েছে।”
তিনি আরও জানান, এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস কার্ল ভিনসন’ ও এর সঙ্গে চলা অন্যান্য সামরিক নৌযান। হুতিরা বলছে, তারা এই হামলায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পেরেছে, যদিও মার্কিন সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
পূর্ববর্তী হামলার ধারাবাহিকতায় নতুন অভিযান
এই হামলা ছিল হুতিদের ধারাবাহিক অভিযানের অংশ। এর আগে, হুতিরা লহিত সাগরে (Red Sea) যুক্তরাষ্ট্রের অপর বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস হ্যারি এস ট্রুম্যান’-কে লক্ষ্যবস্তু করে একটি সফল আক্রমণ চালানোর দাবি করে। ওই হামলার পরপরই ‘হ্যারি ট্রুম্যান’ জাহাজটিকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল বলে দাবি করে হুতিরা।
হুতিদের মতে, সেই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি F/A-18E সুপার হর্নেট যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে, যা মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য বড় ধরনের ক্ষতি বলে বিবেচিত।
হুতিদের শক্তির বিস্তার: আরব সাগর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ২০১৪ সাল থেকে সৌদি-সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে রাজধানী সানাসহ বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে রেখেছে। ইরান-সমর্থিত এই শিয়া গোষ্ঠী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ড্রোন, ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং সমুদ্রপথে আক্রমণ চালানোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করেছে।
২০২৩ সালের শেষ দিকে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিবাদে হুতিরা লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করে। এরপর থেকেই মার্কিন ও পশ্চিমা জাহাজগুলো হুতিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা জবাব: বিমান হামলায় অভিবাসীদের মৃত্যু
হুতিদের এ ড্রোন হামলার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন বাহিনী উত্তর ইয়েমেনের সাদা প্রদেশে পাল্টা বিমান হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্য ছিল হুতি ঘাঁটি, কিন্তু এতে ধ্বংস হয় একটি আফ্রিকান অভিবাসী আশ্রয়কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এই হামলায় অন্তত ৬৮ জন আফ্রিকান অভিবাসী নিহত ও ৪৭ জন আহত হয়েছেন।
এই ঘটনাটি ব্যাপক নিন্দার জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ঘটনার তদন্ত ও দায়ীদের জবাবদিহির দাবি জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মত: হুতিদের সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্লেষকরা বলছেন, হুতিদের এই ধরণের আক্রমণ শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। জেনেভা ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর গবেষক ড. মার্টিন হেনরি বলেন, “হুতিদের ড্রোন প্রযুক্তি ও সমুদ্রপথে আক্রমণ চালানোর সক্ষমতা শুধু ইয়েমেন সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই হামলার মধ্য দিয়ে হুতিরা তাদের যুদ্ধক্ষমতার নতুন রূপ দেখিয়েছে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের ইঙ্গিতও দিতে পারে।”
হুতিদের হামলার কারণ ও রাজনৈতিক বার্তা
হুতিরা দীর্ঘদিন ধরে ইয়েমেনে সৌদি আরব এবং মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছে। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তারা নিজেকে মুসলিম বিশ্বের “প্রতিরোধ ফ্রন্ট”-এর অংশ হিসেবে তুলে ধরছে।
বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী গাজার ঘটনাপ্রবাহে ইসরায়েলকে সহায়তা করছে—এই অভিযোগেই হুতিরা মার্কিন রণতরীগুলোকে লক্ষ্য করছে।
আঞ্চলিক উত্তেজনার প্রভাব ও পরবর্তী পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় আকারের সামরিক সংঘাত শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যদি হুতিদের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযান চালায়, তবে তা ইয়েমেন যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে পারে।
এদিকে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (GCC) দেশগুলো এই ঘটনাগুলো ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
সমুদ্রপথে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জে বিশ্ব রাজনীতি
এই ড্রোন হামলা শুধু একটি যুদ্ধজাহাজের ওপর হামলা নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক জলপথে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সংকটের প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া, হুতিদের পরবর্তী পরিকল্পনা, এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অবস্থান—সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।