কাশ্মীর হামলা ভারত কীভাবে পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে পারে

কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর উপমহাদেশে আবারও চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরাসরি পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে, আর পাকিস্তান পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে আসন্ন ভারতীয় সামরিক অভিযানের বিষয়ে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক টানটান, সীমান্তে গোলাগুলি চলছে, আর গোটা অঞ্চলজুড়ে শঙ্কা—নতুন করে কোনো সংঘর্ষ কি শুরু হতে যাচ্ছে?
এই পরিস্থিতিতে অনেকেই জানতে চাচ্ছেন—ভারত আসলে কী ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে? অতীতে তারা কী করেছে, এবং ইতিহাস আমাদের কী শেখায়?
কী ঘটেছে পেহেলগামে?
২২ এপ্রিল, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত হন অন্তত ২৬ জন পর্যটক। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের ‘যোগসূত্র’ রয়েছে—এমন অভিযোগ আনেন ভারতের কর্মকর্তারা। যদিও পাকিস্তান এ অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘উসকানিমূলক’ আখ্যা দিয়েছে।
এ ঘটনার পর থেকেই নয়াদিল্লি থেকে একের পর এক উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠক চলছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দিনে অন্তত দুবার নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং সেনাবাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিয়েছেন—এমন তথ্য দিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার ৩০ এপ্রিল দাবি করেন, তাঁদের কাছে ‘বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য’ রয়েছে যে ভারত ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সীমিত আকারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে পারে।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ
এই উত্তেজনার মধ্যে মধ্যস্থতায় নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস—দুই পক্ষকেই সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারত কী ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে?
ভারত অতীতে চার ধরনের সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাকিস্তানের প্রতি। এগুলো ইতিহাসে নথিভুক্ত এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে আবারও পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা রয়েছে।
১. গোপন সামরিক অভিযান
ভারতের সেনাবাহিনী অতীতে বহুবার গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এসব অভিযানের কথা সরকার কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না। উদাহরণস্বরূপ, কাশ্মীরের উরিতে ২০১৬ সালের হামলার পর ভারতের ‘গোপন অভিযান’ চালানোর দাবি উঠে। এই কৌশলের লক্ষ্য মূলত শত্রুপক্ষকে সতর্ক বার্তা দেওয়া, যাতে কোনো বড় যুদ্ধ ছাড়াই পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানানো যায়।
২. প্রকাশ্য ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’
২০১৬ সালের উরি হামলার জবাবে ভারত প্রকাশ্যে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর ঘোষণা দেয়। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঢুকে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে আঘাত হানা হয়েছিল বলে দাবি করে নয়াদিল্লি। এতে ভারতীয় জনমতও মোদির পক্ষে দাঁড়ায়। রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং সামরিক শক্তি প্রদর্শনের কৌশল হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।
৩. আকাশপথে হামলা
২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হওয়ার পর ভারতের বিমানবাহিনী পাকিস্তানের বালাকোটে ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। যদিও পাকিস্তান বলেছিল, ওই হামলায় তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ ঘটনার পর দুই দেশের যুদ্ধবিমান মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়ায় এবং একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত হয়।
৪. পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বা দখল অভিযান
ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে চারটি যুদ্ধ করেছে, যার মধ্যে তিনটিই কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে পাকিস্তান সেনারা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়লে, ভারত পাল্টা সামরিক অভিযান চালিয়ে তাদের পিছু হটাতে বাধ্য করে।
এছাড়া ১৯৮৪ সালে সিয়াচেন হিমবাহ দখলের ঘটনায় ‘অপারেশন মেঘদূত’-এর মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানকে চমকে দেয়। এখন পর্যন্ত এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু যুদ্ধক্ষেত্র।
বর্তমান প্রস্তুতি: রাফায়েল ও ক্ষেপণাস্ত্র
পেহেলগাম হামলার পর ভারতের নৌবাহিনী সফলভাবে জাহাজ–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। পাশাপাশি তারা ফ্রান্স থেকে আরও ২৬টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিও করছে। ভারতের এই প্রস্তুতি দেখে অনেকেই বলছেন, বড় ধরনের অভিযান না হলেও সীমিত আকারে প্রতিক্রিয়া আসতে পারে।
পাকিস্তানের প্রস্তুতি ও বার্তা
পাকিস্তান বলেছে, তারা ‘উসকানিমূলক’ কোনো পদক্ষেপ আগে নেবে না। তবে প্রয়োজনে নিজেদের রক্ষা করতে প্রস্তুত রয়েছে। ইসলামাবাদ একাধিকবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।
পর্যালোচনা: যুদ্ধ নাকি কূটনীতি?
ভারতের প্রতিক্রিয়ার ধরন একাধিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে—অভ্যন্তরীণ জনমত, আন্তর্জাতিক চাপ, সামরিক সক্ষমতা এবং পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি। অতীতে দেখা গেছে, ‘সীমিত ও নিশানাভিত্তিক’ প্রতিক্রিয়া ভারতের জন্য কার্যকর হয়েছে রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় দিক থেকেই।
তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। কাশ্মীরের ভেতরে পর্যটকদের ওপর হামলা—ভারতের নিরাপত্তা নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এর জবাবে মোদি সরকার কড়া প্রতিক্রিয়া দেখালে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাস রক্তাক্ত ও জটিল। কাশ্মীর ইস্যু বারবার উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এবার কোনোপক্ষ যদি ভুল পদক্ষেপ নেয়, তা পরিণত হতে পারে আরও বড় সংকটে। যুদ্ধ নয়, এই মুহূর্তে দরকার সর্বোচ্চ কূটনৈতিক সংযম ও আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান খোঁজা।