বাজেটে কড়াকড়ি বাড়বে, গড়বে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল

চলতি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সরকার একদিকে যেমন রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কঠোর নীতির ঘোষণা দিয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের শিল্পভিত্তিক রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (FTZ) গঠনের উদ্যোগও নিয়েছে। এই দুটি ঘটনাই দেশের ব্যবসায়ী সমাজ এবং বিনিয়োগ পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কর নিয়ে দ্বন্দ্ব: ‘করছাড়ের দিন শেষ’
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় বাজেট-প্রস্তুতি নিয়ে সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, এনবিআর কর্মকর্তারা এবং দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা মুখোমুখি হন।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট করে বলেন, “করছাড়ের দিন শেষ। এখন কর দিয়ে সুবিধা নিতে হবে।” সরকারের রাজস্ব ঘাটতি পূরণে কর আদায়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি জানান, অটোমেশন ও করব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন জোরদার করা হচ্ছে, যাতে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়।
তবে ব্যবসায়ীদের বক্তব্য ছিল একেবারেই ভিন্ন সুরে। বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ বলেন, “৩০ হাজার টাকার শুল্ক দিতে গিয়ে ৫০ হাজার টাকার ঘুষ দিতে হয়।” তিনি এনবিআরের ক্ষমতা হ্রাস ও গঠনমূলক সংস্কারের দাবি জানান।
মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কুমিল্লা ইকোনমিক জোনে ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগের দুই বছর পরও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়াটা দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতি চরম অবহেলার উদাহরণ। তার মতে, “নিজেদের বিনিয়োগকারীদের অবহেলা করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা।“
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভ্যাট সংক্রান্ত জটিল কাগজপত্র ও অপ্রয়োজনীয় হয়রানি ব্যবসার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি সোলার প্যানেল আমদানিতে উচ্চ করের সমালোচনা করে বলেন, “জ্বালানি সংকটের সমাধানে ব্যবসায়ীরা সোলার প্যানেল ব্যবহার করতে চাইলেও সরকার কর দিয়ে তাদের নিরুৎসাহিত করছে।“
কর কাঠামোতে প্রস্তাব ও প্রত্যাখ্যান
এফবিসিসিআই সাধারণ করদাতার বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা ৩.৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪.৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া রপ্তানি খাতে উৎসে করের হার ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করে আগামী পাঁচ বছর ধরে তা বজায় রাখার সুপারিশও আসে।
তবে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান করপোরেট কর হ্রাসের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। পরিবর্তে তিনি কর ব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন, অটোমেশন প্রকল্প এবং নতুন বন্ড ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেন।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও আইএমএফ
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা বাজেটে প্রত্যাশার ফুলঝুরি দেব না, বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা আনব।” তিনি আশ্বস্ত করেন, “আইএমএফের ঋণ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, ইতোমধ্যেই সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।“
মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ
এই কঠোর করনীতি ও বাজেট বাস্তবতায় আরও একটি বড় খবর এসেছে: সরকার আগামী এক বছরের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (FTZ) স্থাপন করতে যাচ্ছে। এই উদ্যোগের নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইআরডি, শিল্প মন্ত্রণালয়, এনবিআর, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিডার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেটি FTZ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা প্রস্তুত করবে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানিয়েছেন, “সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় নিশ্চিত করা গেলে চলতি বছরের মধ্যেই দেশের প্রথম FTZ ঘোষণা সম্ভব হবে।“
কেন প্রয়োজন FTZ?
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে FTZ একটি কৌশলগত পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সিঙ্গাপুরের জুরং দ্বীপ ও দুবাইয়ের জেবেল আলী FTZ এর মতো মডেল বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত কাঠামো তৈরি করা হবে।
FTZ এর মাধ্যমে কী অর্জন সম্ভব:
- বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ
- রপ্তানি প্রবৃদ্ধি
- প্রযুক্তি স্থানান্তর
- ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি
বর্তমানে উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ, ভৌগোলিক সুবিধা ও লজিস্টিক সহায়তা বিশ্লেষণের কাজ চলছে। আগামী ৬ মে জাতীয় কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে সরকারের কঠোর রাজস্বনীতি একদিকে যেমন ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন করছে, অন্যদিকে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে। কর আদায়ে স্বচ্ছতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণে বাস্তববাদ—এই তিনটি উপাদানের সমন্বয়েই দেশের অর্থনৈতিক উত্তরণ নির্ভর করছে।