বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, রপ্তানিতে নেই আশানুরূপ অগ্রগতি

বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে সম্মানজনক অবস্থানে থাকলেও রপ্তানির দিক দিয়ে এখনও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি মনে করেন, দেশের মাছ রপ্তানি বৃদ্ধিতে প্রয়োজন আলাদা ইকোনমিক জোন, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় রপ্তানিযোগ্য মাছ প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হবে।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু) ‘সিভাসু ফিশ ফেস্টিভ্যাল-২০২৫’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। অনুষ্ঠানে মৎস্য খাতের বর্তমান অবস্থা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেন তিনি।
বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ও রপ্তানি পরিস্থিতি
ফরিদা আখতার জানান, “বাংলাদেশে প্রতিবছর একজন মানুষ গড়ে যে পরিমাণ মাছ খায়, তা একদিকে ইতিবাচক। তবে মাছভিত্তিক পুষ্টি আরও বাড়ানো সম্ভব। এতে যেমন পুষ্টিহীনতা দূর হবে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, দেশে বছরে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন টন মাছ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র স্কেল ফিশারিজ বা ছোট মৎস্যচাষিদের অবদান প্রায় ১.২৯ মিলিয়ন টন। এত বড় উৎপাদনের পরেও দেশের ৯৭ শতাংশের বেশি মাছ স্থানীয় বাজারেই বিক্রি হয়ে যায়, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির পরিমাণ এখনও খুবই কম।
বিশেষত সাদা মাছ রপ্তানির বাজারে বাংলাদেশ এখনও প্রবেশ করতে পারেনি, যেখানে অন্য দেশগুলো ইতোমধ্যে সক্রিয়। উপদেষ্টার মতে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মান বজায় রাখার সুযোগের অভাব।
বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান
বর্তমানে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে, আর অ্যাকোয়াকালচারে (জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ একত্রে উৎপাদন) পঞ্চম এবং সামুদ্রিক মাছ উৎপাদনে ১১তম অবস্থানে রয়েছে।
উপদেষ্টা জানান, “এই সাফল্য আমাদের আরও উৎসাহিত করে। তবে এই অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে হলে রপ্তানির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।”
ওয়ার্ল্ডফিশ-এর গবেষণা ও অবদান
আলোচনায় ফরিদা আখতার বিশেষভাবে প্রশংসা করেন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশ-এর অবদান নিয়ে। তিনি বলেন, “ওয়ার্ল্ডফিশ আমাদের দেশে রুই ও কাতলার মতো বড় মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করেছে এবং এর সমাধানের জন্য সুস্পষ্ট কর্মপন্থা দিয়েছে। তাদের গবেষণা দেশের মৎস্য খাতে অভাবনীয় অবদান রাখছে।”
আন্তর্জাতিক মানের প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানির দাবি
সরকারের তরফ থেকে রপ্তানি বৃদ্ধিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সে প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, “আলাদা ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যেখানে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে মাছ প্রক্রিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক বাজারে পাঠানো যাবে। এতে করে দেশের মাছ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় মাধ্যম হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “রপ্তানিযোগ্য মাছের মান বজায় রাখতে হলে স্টোরেজ, প্রক্রিয়াকরণ এবং কোল্ড চেইন অবকাঠামো আরও উন্নত করতে হবে। এ খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাও সময়ের দাবি।”
মাছ খাওয়ার হার বাড়াতে জনসচেতনতার তাগিদ
দেশে মাছ খাওয়ার হার বাড়ানোরও পরামর্শ দেন উপদেষ্টা। তার মতে, “মাছের পুষ্টিগুণ সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও বেশি করে প্রচার করা দরকার। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী ও বয়স্কদের মধ্যে মাছভিত্তিক পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরলে এটি জাতীয় পুষ্টিনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
সিভাসু ফিশ ফেস্টিভ্যালে প্রাণবন্ত উপস্থিতি
দুই দিনব্যাপী সিভাসু ফিশ ফেস্টিভ্যাল-২০২৫-এ উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের ৫৫০ জন শিক্ষক, গবেষক, উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট খাতের প্রতিনিধিরা। আয়োজনে ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৯৫টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শেখ আহমাদ আল নাহিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন:
- এসিআই অ্যাগ্রো লিংক লিমিটেডের বিজনেস পরিচালক সাঈদ এম ইশতিয়াক
- বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এনাম চৌধুরী
- নিরিবিলি গ্রুপ ও শ্রিম্প অ্যান্ড ফিশ ফাউন্ডেশন অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি লুৎফর রহমান কাজল
- বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র
- মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুর রউফ
- রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আতিয়ার রহমান
চিফ প্যাট্রোন হিসেবে বক্তব্য দেন সিভাসুর উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান।
সামগ্রিকভাবে এই আয়োজনটি দেশের মৎস্য খাতে গবেষণা, উন্নয়ন, রপ্তানি ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন আয়োজকরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানির সুযোগ বাড়ালে দেশের মাছ শিল্প আরও বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপ নিতে পারে।