পেহেলগাম ইস্যুতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি ভারত

পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে ভারতের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভারত এই অভিযোগের সমর্থনে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। এর বিপরীতে, তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী সন্ত্রাসবাদে ভারতের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছেন। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন এই তথ্য প্রকাশ করে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ আরও জানান, ভারত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে একটি সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে। এই নেটওয়ার্ককে ভারত থেকে বিস্ফোরক, ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। তিনি জানান, এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য শিগগিরই বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে উপস্থাপন করা হবে।
তিনি বলেন, “গত ২৫ এপ্রিল ভারতে প্রশিক্ষিত একজন সন্ত্রাসীকে পাকিস্তানে আটক করা হয়েছে। তিনি পাকিস্তানি নাগরিক। তার কাছ থেকে একটি আইইডি এবং তার বাড়ি থেকে ভারতের তৈরি ড্রোন উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত উপকরণের ফরেনসিক বিশ্লেষণে ভারতীয় সন্ত্রাসবাদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই তথ্য যে কোনো স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা যাচাই করতে পারে।”
পেহেলগাম হামলার পটভূমি
গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পেহেলগামের কাছে বাইসারান উপত্যকায় সশস্ত্র ব্যক্তিরা পর্যটকদের লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এই হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই পর্যটক ছিলেন। নিহতদের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দা, দুজন স্থানীয় কাশ্মীরি, একজন নেপালি এবং একজন সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাগরিক ছিলেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন আহত হন। এটি ২০০০ সালের পর কাশ্মীরে সংঘটিত সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লশকর-ই-তাইয়েবার সহযোগী গোষ্ঠী ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)-কে দায়ী করেছে। তবে, পাকিস্তান সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, টিআরএফ প্রথমে হামলার দায় স্বীকার করলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়। এই দায় স্বীকারের বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ও পাকিস্তানের জবাব
হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা, পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বহিষ্কার, আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করা এবং পাকিস্তানের সরকারি এক্স হ্যান্ডেল বন্ধ করে দেওয়া। ভারতের দাবি, হামলায় জড়িত তিনজন পাকিস্তানি এবং একজন কাশ্মীরি সন্ত্রাসী ছিলেন, যাদের মধ্যে আদিল ঠোকার নামে একজন স্থানীয় ব্যক্তি গাইড হিসেবে কাজ করেছিলেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এই অভিযোগের জবাবে বলেছেন, পাকিস্তান একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তে অংশ নিতে প্রস্তুত। তিনি ভারতের ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ’ করার প্রবণতার সমালোচনা করেন এবং কাশ্মীর ইস্যুকে পাকিস্তানের ‘শিরার স্পন্দন’ হিসেবে উল্লেখ করে কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে অটল সমর্থন ব্যক্ত করেন।
ভারতের অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপ ও মানবাধিকার উদ্বেগ
পেহেলগাম হামলার পর ভারত-শাসিত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। এই অভিযানে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বাড়িঘর বুলডোজার ও আইইডি দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদের নামে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং পরিবারের সদস্যদেরও আটক করা হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই পদক্ষেপকে ‘সম্মিলিত শাস্তি’ হিসেবে বর্ণনা করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।
এদিকে, ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) ঘটনাস্থলে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তকারীরা দাবি করেছেন, এই হামলা একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার পেছনে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের হাত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পেহেলগাম হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইসরায়েল, ডেনমার্ক এবং বাংলাদেশ হামলার নিন্দা জানিয়ে ভারতের পাশে থাকার কথা বলেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তবে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি সতর্ক করে বলেছেন, ভারতের সীমিত সামরিক পদক্ষেপও পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার কারণে উত্তেজনাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
পেহেলগাম হামলা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ককে আরও জটিল করেছে। কাশ্মীর ইস্যু দুই দেশের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। ২০১৯ সালে ভারত কর্তৃক জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিলের পর থেকে এই অঞ্চলে সহিংসতা বেড়েছে। পাকিস্তান বরাবরই কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি করে আসছে, যা ভারত সরকার প্রত্যাখ্যান করে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফের অভিযোগ, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করছে, এটি দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগের ধারাবাহিকতার অংশ। তিনি পূর্ববর্তী ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে পাকিস্তানে ৭১,৪২৯টি গোয়েন্দাভিত্তিক অভিযানে ১,২৫০ সন্ত্রাসী নিহত এবং ৫৬৩ নিরাপত্তা কর্মী শহীদ হয়েছেন।