শিক্ষা

হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত: গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা ও বিধান জেনে নিন

প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখো মুসলমান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পবিত্র মক্কা শরিফে গিয়ে হজ পালন করেন। এটি শুধু একটি ইবাদতই নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি মহামিলনমেলা, এক অতুলনীয় আত্মিক যাত্রা। হজ পালনের সময় মুসলমানরা একই পোশাকে, একই কণ্ঠে তালবিয়া পাঠ করে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা, আনুগত্য এবং আত্মসমর্পণ প্রকাশ করে থাকেন।

হজের মৌলিক নিয়ম-কানুন, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও নিষিদ্ধ কাজগুলোর সঠিক জ্ঞান না থাকলে একজন হাজির হজ আদায় অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। তাই আজকের প্রতিবেদনটিতে হজের প্রয়োজনীয় আহকাম ও মাসআলাগুলো সহজ ভাষায় তুলে ধরা হলো।

হজ কী?

ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে, নির্দিষ্ট সময়ে (৮ থেকে ১২ জিলহজ) মক্কা ও তার আশপাশের নির্দিষ্ট স্থানে কিছু নির্ধারিত ইবাদত পালনের নামই হজ। এটি ইসলাম ধর্মের পঞ্চ স্তম্ভের একটি এবং আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য একবার হজ পালন করা ফরজ।

আল্লাহ বলেন:
“মানুষের ওপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ, যদি তার সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য থাকে।”
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)

হজের তিনটি প্রকারভেদ

হজ তিনভাবে আদায় করা যায়—

১. হজে তামাত্তু:
ওমরাহ এবং হজ ভিন্ন ভিন্ন ইহরাম ও নিয়তে পালন করা।

২. হজে কিরান:
একই ইহরামে ও একই নিয়তে ওমরাহ ও হজ পালন করা।

৩. হজে ইফরাদ:
শুধুমাত্র হজ করার জন্য ইহরাম বাঁধা এবং ওমরাহ না করা।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, হজে কিরান সর্বোত্তম, কারণ এতে ইবাদতের সময়কাল দীর্ঘ হয় এবং এটি নবী করিম (সা.)-এর বিদায় হজের আদর্শ। অন্যদিকে, অধিকাংশ ফকিহর মতে, যাঁরা দীর্ঘদিন ইহরামের বিধিনিষেধ মানতে অসুবিধা অনুভব করেন, তাঁদের জন্য হজে তামাত্তু উত্তম।

হজের ফরজ (৩টি)

১. ইহরাম বাঁধা:
হজ শুরু করার জন্য ইহরাম বাধা ফরজ। এটি হজের নিয়তের প্রকাশ এবং কিছু নির্দিষ্ট পোশাক পরিধানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

২. উকুফে আরাফা:
৯ জিলহজ আরাফার ময়দানে সূর্য হেলার পর থেকে ঈদের দিন সুবহে সাদিক পর্যন্ত যেকোনো সময়ে উপস্থিত থাকা। এটি হজের মূল অংশ।

৩. তাওয়াফে জিয়ারত:
আরাফা থেকে ফিরে এসে কাবা শরিফের সাতবার চক্কর দেওয়া ফরজ।

হজের ওয়াজিব (৬টি)

১. মুজদালিফায় অবস্থান:
১০ জিলহজ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত কিছু সময় মুজদালিফায় থাকা।

২. সায়ি (সাফা-মারওয়ার মধ্যে সাতবার চলাফেরা):
এটি ওমরাহ ও হজ উভয়েরই অংশ।

৩. রমি (জামারায় পাথর নিক্ষেপ):
শয়তানকে প্রতীকীভাবে পাথর নিক্ষেপ করা হয় মিনায়।

৪. কোরবানি:
তামাত্তু বা কিরান হজকারীর জন্য পশু কোরবানি ওয়াজিব।

৫. চুল কাটা বা মাথা মুন্ডানো:
হজ শেষে ইহরাম থেকে বের হওয়ার প্রতীক হিসেবে এটি করা হয়।

৬. তাওয়াফে বিদা:
মক্কা ছাড়ার আগে কাবা শরিফে বিদায়ী তাওয়াফ।

হজের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতসমূহ

  • ইহরাম বাঁধার আগে গোসল বা অজু করা এবং শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার।
  • সাদা, পরিষ্কার কাপড় পরা।
  • ইহরামের আগে দুই রাকাত নামাজ পড়া।
  • বেশি বেশি তালবিয়া পাঠ করা।
  • তাওয়াফ শুরু করার সময় ডান কাঁধ খোলা রেখে চাদর পেঁচানো (ইজতিবা)।
  • তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে দ্রুত গতিতে চলা (রমল)।
  • মিনায় কোরবানির দিনগুলোতে রাত যাপন।
  • মক্কায় অবস্থানকালে বেশি বেশি তাওয়াফ করা।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ

নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য নিষিদ্ধ কাজ:

  • সুগন্ধি ব্যবহার
  • নখ কাটা বা লোম উপড়ানো
  • পশু শিকার
  • মাথার চুল কাটা বা ফেলা
  • ঝগড়া-বিবাদ
  • যৌন আচরণ বা সম্পর্ক

পুরুষদের জন্য অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা:

  • সেলাই করা কাপড় পরা
  • মাথা ও মুখ ঢেকে ফেলা
  • টাকনু ঢেকে যায় এমন জুতা পরিধান

নারীদের জন্য নিষেধ:

  • অলংকার পরা
  • মুখ ঢেকে নিকাব পরা (পুরুষ থাকলেও মুখ ঢাকতে পারবে না)
  • হাত মোজা পরা
  • উকুন মারা

যেসব কারণে দম বা সদকা ওয়াজিব হয়

  • ইহরাম ছাড়া মিকাত পার হওয়া
  • ইহরাম অবস্থায় সুগন্ধি ব্যবহার
  • শরিয়তসম্মত নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন

এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য আলেম, হজ গাইড বা অভিজ্ঞ মুআল্লিমের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

হজ কেবল আনুষ্ঠানিক রীতিনীতির বিষয় নয়; এটি আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যম, একটি প্রশিক্ষণ যেখানে মানুষ আত্মত্যাগ, ধৈর্য, সমতা ও একত্ববোধের শিক্ষা লাভ করে। সঠিক নিয়ম অনুসরণ করেই একজন মুসলমানের হজ পূর্ণাঙ্গ ও কবুল হয়। তাই হজে যাওয়ার আগে অবশ্যই এসব ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও নিষেধাজ্ঞা ভালোভাবে জেনে রাখা জরুরি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button