বনশ্রীর মেরাদিয়ায় কোরবানির পশুর হাট বসানো যাবে না: হাইকোর্টের নির্দেশ

ঢাকার বনশ্রীর মেরাদিয়ায় কোরবানির পশুর হাট বসানোর অনুমতি তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী জিনাত হক এবং আইনুন নাহার সিদ্দিকার দ্বৈত বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন সিকদারের করা একটি রিট আবেদনের শুনানি শেষে আদালত এ আদেশ দেন। রিটের শুনানিতে আদালত বলেন, জনস্বার্থে এবং এলাকার পরিবেশ ও নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের সিদ্ধান্ত জরুরি।
কী ছিল রিটের আবেদনে?
রিটকারীর পক্ষে আইনজীবী জানান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মেরাদিয়া এলাকাকে ‘খালি স্থান’ দেখিয়ে পশুর হাট বসানোর জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। অথচ বাস্তবে মেরাদিয়া একটি ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা। এ ধরনের আবাসিক এলাকায় কোরবানির হাট বসালে প্রতিবছর ব্যাপক জনদুর্ভোগ তৈরি হয়।
শহরের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, যানজট বেড়ে যায়, ময়লা-আবর্জনার সমস্যা তৈরি হয় এবং নিরাপত্তা ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় জনগণ বেশ কিছুদিন ধরেই হাট বসানোর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন।
আইনজীবী আরো জানান, রিটে মূলত এই যুক্তিগুলো তুলে ধরা হয়েছিল যে, আবাসিক এলাকায় কোরবানির হাট বসানো নাগরিক অধিকার ও মৌলিক সুবিধার পরিপন্থী। এই হাটের ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হয়, যা সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
হাইকোর্ট আদেশে বলেন, জনস্বার্থে রিটটি গুরুত্বপূর্ণ। আদালত উল্লেখ করেন, “একটি আবাসিক এলাকায় এমন বড় আকারের অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হলে, তা শুধু বাসিন্দাদের জন্য নয়, সামগ্রিক নগর ব্যবস্থাপনার জন্যও ক্ষতিকর।”
আদালত আরও জানান, যখনই জনস্বার্থের বিষয় উঠে আসে, তখন আদালতের দায়িত্ব হয় তা যথাযথভাবে বিবেচনা করা।
ডিএনসিসির অবস্থান
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মেরাদিয়া এলাকার নির্দিষ্ট একটি খালি জমিতে পশুর হাট বসানো হবে। এতে আশপাশের এলাকায় কোনো সমস্যা তৈরি হবে না বলে তারা দাবি করেছিল।
তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগে উঠে আসে, বিগত বছরগুলোতে মেরাদিয়ায় পশুর হাট বসানোর ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতা, দুর্গন্ধ, শব্দদূষণ এবং চলাচলের সমস্যা এই এলাকার মানুষের নিত্যদিনের ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছিল।
অতীতের অভিজ্ঞতা
গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হয়। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, এই হাটগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং নির্ধারিত স্থানে বসানোর কথা।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এসব হাট আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠায় নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। বিশেষ করে বনশ্রী, মেরাদিয়া, আফতাবনগরসহ আশেপাশের এলাকায় এ সমস্যাটি প্রকট ছিল। যানজট, ময়লার স্তূপ, স্যানিটেশন সমস্যাসহ নানা ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হতো।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কোরবানির পশুর হাটের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। হাট চলাকালীন সময়ে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, অফিসগামী কর্মজীবী মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। এছাড়া হাটের নিরাপত্তা নিয়েও ছিলো প্রশ্ন।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতামত
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, আবাসিক এলাকায় কোনো ধরনের অস্থায়ী হাট, মেলা বা বড় জনসমাগম সৃষ্টি করে এমন কার্যক্রম নিরুৎসাহিত করা উচিত।
পরিকল্পনাবিদ মো. রুহুল আমিন জানান, “একটি সুশৃঙ্খল ও বাসযোগ্য নগর গড়ে তুলতে হলে স্থান নির্ধারণে বিশেষ যত্নশীল হতে হবে। আবাসিক এলাকা হলো মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার স্থান। এখানে এমন কিছু করা যাবে না যা জনজীবনে বিঘ্ন ঘটায়।”
তিনি আরও বলেন, কোরবানির হাট শহরের বাইরের এলাকায় অথবা নির্দিষ্ট পশুহাট এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এতে নগর ব্যবস্থাপনা সহজ হবে এবং নাগরিক দুর্ভোগ কমবে।
কোরবানির পশুর হাটের বিকল্প পরিকল্পনা
বর্তমানে নগর পরিকল্পনাবিদ ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে আলোচনা চলছে, কিভাবে নির্দিষ্ট স্থানে আধুনিক কোরবানির পশুর হাট স্থাপনা গড়ে তোলা যায়।
- নির্ধারিত পশুর হাট নির্মাণ করে সারা বছর ব্যবহার করা যাবে।
- আবাসিক এলাকা থেকে দূরে সুনির্দিষ্ট পশুর হাটের ব্যবস্থা করতে হবে।
- অনলাইন কোরবানির হাটকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে, যাতে মানুষের ভোগান্তি কম হয়।
২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় অনলাইন কোরবানির পশুর হাটের প্রবণতা বাড়ে। সরকারিভাবে ও বেসরকারিভাবেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পশু কেনাবেচা পরিচালিত হয়েছিল। এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যতেও নগর জীবনে চাপ কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
আদালতের নির্দেশনার প্রভাব
হাইকোর্টের এ আদেশ নগরবাসীর জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে। আবাসিক এলাকার শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখতে এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ডিএনসিসি এখন নতুন করে স্থান নির্ধারণ করে হাটের পরিকল্পনা করতে বাধ্য হবে। সেই সাথে জনস্বার্থের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা হাইকোর্টের এই আদেশে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।