মাগুরার শিশু হত্যা মামলায় আরও তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন: দ্রুত বিচার কার্যক্রম চলছে

মাগুরা সদরের নান্দুয়ালী গ্রামে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় বিচার কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। আলোচিত এই মামলায় দ্বিতীয় দিনে আরও তিনজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আদালত আগামীকাল তৃতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেছে। দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা এই ঘটনায় বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি তুলেছেন শিশুটির পরিবারসহ স্থানীয়রা।
দ্বিতীয় দিনে ৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ
সোমবার (২৮ এপ্রিল) মাগুরা জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আজ সাক্ষ্য দেন নিহত শিশু আছিয়ার চাচা ইব্রাহিম শেখ, আসামি হিটু শেখের বাড়ির পাশের মাদ্রাসার শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন এবং মাদ্রাসারই এক শিক্ষার্থী হজরত।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এদিন সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আসামিদের উপস্থিতিতে প্রত্যেক সাক্ষী তাদের বক্তব্য দেন। তারা শিশুটির ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক আদালতের সামনে উপস্থাপন করেন।
এর আগে, গতকাল (২৭ এপ্রিল) প্রথম দিনে নিহত শিশুর মা এবং আরও দুইজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ফলে দুই দিনে মোট ৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলো। আদালত মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারণ করেছেন।
মামলার পটভূমি
গত ৬ মার্চ মাগুরা সদরের নান্দুয়ালী গ্রামে মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটে। জানা যায়, আছিয়া তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। সেখানে শিশু অবস্থায় সে ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৩ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় আছিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে দ্রুত থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় শিশুটির বোনের শ্বশুর হিটু শেখসহ চারজনকে আসামি করা হয়। ঘটনার পর থেকে এলাকাজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ওঠে।
চার্জশিট ও অভিযোগ গঠন
দীর্ঘ তদন্ত শেষে পুলিশ গত ১৩ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এরপর ২৩ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয়। পুলিশি তদন্তের অংশ হিসেবে আসামি হিটু শেখ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে আদালত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ঘটনার মূল পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, যা মামলার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আদালতের ভূমিকা ও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া
মামলার গুরুত্ব ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় নিয়ে মাগুরা জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বিচারক দ্রুত শুনানি চালিয়ে যাচ্ছেন। আদালত চান, ন্যায়বিচার যেন নিশ্চিত হয় এবং কোনো ধরণের বিলম্ব যেন না ঘটে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানান, “আমরা চাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করে আদালত রায় ঘোষণা করুক। যেহেতু শিশু নির্যাতন ও হত্যার মতো গর্হিত অপরাধের বিচার হচ্ছে, তাই দোষীরা যেন কোনোভাবেই পার পেয়ে না যায়, সেটা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।”
পরিবারের প্রত্যাশা
নিহত আছিয়ার পরিবার বিচারিক কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তবে একই সঙ্গে দ্রুত এবং কঠোর সাজা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন।
আছিয়ার মা বলেন, “আমার মেয়ে আমার চোখের সামনে শেষ হয়ে গেছে। আমি চাই, যারা আমার মেয়ের জীবন কেড়ে নিয়েছে, তাদের কঠিন শাস্তি হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ হয়েছে। মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিলের মাধ্যমে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে শিশুটির নির্মম মৃত্যু।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে শিশু নির্যাতন ও হত্যার বিরুদ্ধে আরও কঠোর আইন প্রয়োগ এবং দ্রুত বিচার সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন, যাতে অপরাধীরা দ্রুত শাস্তি পায় এবং সমাজে একটি ভয় কাজ করে।
শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আরও কঠোরতা প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে শুধু আইনগত বিচার নয়, সমাজিক সচেতনতা, শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধের চর্চা এবং পরিবারভিত্তিক সুরক্ষা ব্যবস্থাও অত্যন্ত জরুরি।
শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি তুলেছেন তারা। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলগুলিতে শিশু সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, সচেতনতা কার্যক্রম বৃদ্ধি করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
মাগুরার এই মর্মান্তিক শিশুহত্যার ঘটনায় বিচারিক প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে চলেছে, যা সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু পরিবারের নয়, বরং রাষ্ট্রেরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার যেন ভবিষ্যতে আর কোনো শিশুর জীবন অকালে ঝরে না যায়, সে প্রত্যাশাই এখন সারাদেশের মানুষের।