চামড়া খাতের দুর্দশা, এক দশকে আয় কমেছে ১৬ কোটি ডলার

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর একটি ছিল চামড়া শিল্প। স্বাধীনতার পর থেকে বহু বছর এই খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় মাধ্যম ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চামড়া শিল্পের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। যেখানে তৈরি পোশাক, ওষুধ শিল্প, আইটি খাতসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাত চমকপ্রদ অগ্রগতি দেখিয়েছে, সেখানে চামড়া খাতের আয় উল্টো কমেছে।
‘ওয়ার্ল্ড লেদার ডে ২০২৫’ উপলক্ষে গত শনিবার সাভারের হরিণধরায় আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ সংক্রান্ত উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০১২ সালে বাংলাদেশের চামড়া খাত থেকে বার্ষিক আয় ছিল ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯৭ কোটি মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ গত এক দশকে আয় কমেছে ১৬ কোটি ডলার।
সংকটের চিত্র
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তির উন্নয়ন না হওয়া, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে না পারা এবং অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতার কারণেই চামড়া শিল্প এ দুরবস্থার মুখে পড়েছে।
লেদার ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড টেকনোলজিস্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বৈঠকে বলেন, “২০-৩০ বছর আগে বাংলাদেশে যে মানের চামড়া উৎপাদন হতো, এখনো সেই মানেই রয়ে গেছে। কোনো আধুনিকীকরণ হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না বাংলাদেশি চামড়া।”
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মান, টেকসই উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে নজর বাড়ানো হলেও বাংলাদেশ এখনো সেই পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে পারেনি।
ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ অনুষ্ঠানে বলেন, “চামড়াশিল্পের সংকট নিরসনে খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় নেই। বর্তমানে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নিয়ন্ত্রণে, যেখানে উদ্যোক্তাদের স্বাধীনতা অনেকটাই সীমিত।”
তিনি মনে করেন, উদ্যোক্তাদের বেশি স্বাধীনতা এবং চটজলদি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ না থাকলে এই শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
চামড়া শিল্পনগরীর সমস্যা
২০১৭ সালে পরিবেশদূষণ ঠেকাতে পুরনো ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে সাভারের হরিণধরায় স্থানান্তর করা হয়। তখন প্রত্যাশা করা হয়েছিল, আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন এই শিল্পনগরী চামড়া শিল্পের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
কিন্তু বাস্তবে শিল্পনগরীতে পানি, বিদ্যুৎ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট (সিইটিপি) পরিচালনায় নানা সমস্যা রয়ে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশের চামড়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান
এক সময় বাংলাদেশ বিশ্বে চামড়া রপ্তানিতে শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় ছিল। তবে বর্তমানে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো বাংলাদেশের চামড়া বাজার দখল করে নিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ মানবসম্পদ এবং কার্যকর বিপণন কৌশলের অভাব বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি দ্রুত আধুনিকীকরণ না করা হয় এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলা হয়, তাহলে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প আরও সংকুচিত হবে।
সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবিত উদ্যোগ
গোলটেবিল আলোচনায় খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বেশ কিছু পরামর্শ দেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- চামড়া প্রক্রিয়াকরণে আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেওয়া।
- আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি।
- উদ্যোক্তাদের নীতিনির্ধারণী স্তরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
- রপ্তানিকারকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ও কর সুবিধা।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
- চামড়া শিল্পনগরীর দ্রুত উন্নয়ন এবং সব ধরনের অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধান।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আন্তর্জাতিক বাজারের পরিবর্তিত চাহিদার সাথে খাপ খাওয়ানো। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং মান নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছতা আনতে না পারলে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে তার অবস্থান আরও হারাবে।
তবে উদ্যোগী হয়ে সরকার, উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো যদি এখনই কার্যকর পরিকল্পনা নেয়, তাহলে চামড়া শিল্প আবারও রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে এখনও বাংলাদেশের চামড়ার সুনাম রয়েছে। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা ও আধুনিকীকরণ করা গেলে এ শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
চামড়া শিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশ এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ খাত। কিন্তু বর্তমানে চামড়া শিল্প কঠিন সময় পার করছে। অব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তির অভাব এবং সমন্বয়হীনতার কারণে এই শিল্পের আয় দিন দিন কমছে। এখনই যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে ভবিষ্যতে এ শিল্প টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। সময় এসেছে শিল্প সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার, সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান খুঁজে বের করার এবং আধুনিক, টেকসই চামড়া শিল্প গড়ে তোলার।