অর্থনীতি

ভারতের চেয়ে কম খরচে কার্গো সেবা দিতে কাজ চলছে: বিমান উপদেষ্টা

বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ঘোষণা করেছেন, ভারতের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম খরচে রফতানিকারকদের জন্য কার্গো সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রোববার (২৭ এপ্রিল) সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম কার্গো ফ্লাইটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের রফতানি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঐতিহাসিক মুহূর্ত: ঢাকার বাইরে প্রথম কার্গো সেবা

শেখ বশিরউদ্দীন তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে কার্গো সেবা চালু করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “অতীতে ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে দমিয়ে রেখে আমাদের পরনির্ভরশীল করে তুলেছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় আমরা স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।” সিলেট থেকে চালু হওয়া এই কার্গো সেবা এই স্বাবলম্বিতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। প্রথম ফ্লাইটটি ৬৬ টন গার্মেন্টস পণ্য নিয়ে স্পেনের উদ্দেশে রওনা দেয়, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য একটি মাইলফলক।

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ: বাংলাদেশের দ্রুত সাড়া

শেখ বশিরউদ্দীন জানান, ভারত সম্প্রতি ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের রফতানি খাতে সাময়িক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে এই সংকট মোকাবিলা করেছি। সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে কার্গো কমপ্লেক্স চালু হওয়ায় আমরা এখন স্বাধীনভাবে আমাদের পণ্য রফতানি করতে পারছি।”

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য এই উদ্যোগ একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। সিলেটের কার্গো কমপ্লেক্সটি প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করবে। তবে ভবিষ্যতে চাহিদার ভিত্তিতে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের জন্য সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য সেবা

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের মূল লক্ষ্য হলো ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদান করা। কার্গো সেবার খরচ কমানোর মাধ্যমে রফতানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারবেন। শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমরা ভারতের তুলনায় অনেক কম খরচে কার্গো সেবা দিতে চাই। এতে আমাদের রফতানিকারকরা লাভবান হবেন, এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।”

সিলেটের কার্গো কমপ্লেক্সটি আধুনিক সুবিধা দিয়ে সজ্জিত। এখানে পণ্য সংরক্ষণ, পরিবহন এবং শুল্ক প্রক্রিয়াকরণের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য সেবা পাবেন।

রফতানি খাতে নতুন সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতের প্রায় ৮৪ শতাংশ রফতানি আয় ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার বাজার থেকে আসে। সিলেট থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট চালুর ফলে এই বাজারে পণ্য পৌঁছানোর সময় এবং খরচ কমবে। এছাড়া, অন্যান্য রফতানি পণ্য, যেমন চামড়াজাত পণ্য, কৃষিপণ্য এবং হস্তশিল্পও এই সেবার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও সহজে পৌঁছাতে পারবে।

ব্যবসায়ী নেতারা এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জানান, “এই কার্গো সেবা আমাদের ব্যবসার জন্য একটি গেম-চেঞ্জার। আমরা এখন কম খরচে এবং দ্রুত আমাদের পণ্য বিদেশে পাঠাতে পারব।”

সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

সরকারের পরিকল্পনা শুধু সিলেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শেখ বশিরউদ্দীন জানান, ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য বিমানবন্দরেও কার্গো সেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে আরও গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট চালুর বিষয়ে আলোচনা চলছে।

তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের বিমান চলাচল অবকাঠামোকে আরও আধুনিক করছি। এতে করে আমরা শুধু রফতানিই নয়, আমদানি এবং পর্যটন খাতেও নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারব।”

চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা

নতুন এই কার্গো সেবা চালুর পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশেষ করে, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং দক্ষ জনবলের ঘাটতি এই উদ্যোগের গতি কিছুটা ধীর করতে পারে। তবে সরকার এই সমস্যাগুলো সমাধানে ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। সিলেটের কার্গো কমপ্লেক্সে নতুন নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া, বিমানবন্দরের রানওয়ে এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই কার্গো সেবা বাংলাদেশের রফতানি খাতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। বিশেষ করে, ভারতের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বাণিজ্যে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে।

উপসংহার

সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কার্গো সেবা চালু হওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। ভারতের তুলনায় কম খরচে এবং দ্রুত পণ্য রফতানির এই উদ্যোগ দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে, বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্যে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button