সম্ভাব্য উত্তরসূরির নাম ঘোষণা করলেন ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস

ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। দীর্ঘদিনের জল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং নিজের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হুসেন আল-শেখের নাম ঘোষণা করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তা কমাতে ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তার অবসান
৮৯ বছর বয়সী মাহমুদ আব্বাস ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর থেকে পিএলও এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) উভয়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তবে এতোদিন ধরে তিনি উত্তরসূরি মনোনয়ন কিংবা নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে আসছিলেন। ফলে ফিলিস্তিনি জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলে একটি অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
বর্তমানে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড বিশেষ করে পশ্চিম তীরে ক্রমবর্ধমান সংকট এবং গাজা সংকটের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
কে এই হুসেন আল-শেখ?
১৯৬০ সালে জন্ম নেওয়া হুসেন আল-শেখ ফাতাহ দলের একজন শীর্ষ নেতা। দীর্ঘদিন ধরেই মাহমুদ আব্বাসের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছেন তিনি। ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা পিএর প্রধান কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেছেন। তাকে একজন ‘বাস্তববাদী নেতা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে।
তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী থাকা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে তাকে বন্দী করা হয়েছিল।
পিএলওতে নতুন পদ ও অনুমোদন
পিএলওর সেন্ট্রাল কাউন্সিল গত সপ্তাহের বৈঠকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ সৃষ্টির অনুমোদন দেয়। এরপর ২৬ এপ্রিল রামাল্লায় অনুষ্ঠিত পিএলও নির্বাহী কমিটির বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে হুসেন আল-শেখকে এই পদে মনোনীত করা হয়। এক বিবৃতিতে পিএলও এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এই মনোনয়ন শুধু মাহমুদ আব্বাসের উত্তরসূরি নির্ধারণ নয়, বরং ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার একটি বড় পদক্ষেপ বলেও মনে করা হচ্ছে।
কেন এখন এই সিদ্ধান্ত?
বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিম তীরে এবং গাজায় চলমান সংঘাত, আন্তর্জাতিক চাপ এবং পিএর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এই সিদ্ধান্তের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে পিএতে সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে আসছিল, যাতে করে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয় এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
গাজায় চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে এই চাপ আরও বেড়েছে। গাজা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন ও শাসনের জন্য একটি শক্তিশালী এবং সংস্কারকৃত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা এখন প্রবল।
পিএর বর্তমান সংকট ও জনপ্রিয়তার পতন
যদিও হুসেন আল-শেখের মনোনয়ন গুরুত্বপূর্ণ, তবে বাস্তবতা হলো—ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছর ধরে মারাত্মকভাবে কমে এসেছে। এর পেছনে আছে—
- দুর্নীতির অভিযোগ: পিএর বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে।
- স্বাধীনতার লক্ষ্যে অগ্রগতির অভাব: ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো রাজনৈতিক অগ্রগতি না হওয়ায় সাধারণ ফিলিস্তিনিদের হতাশা বেড়েছে।
- ইসরায়েলি সেনা অভিযানের তীব্রতা: পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের হার বেড়ে চলেছে, যার ফলে পিএর নিয়ন্ত্রণ ও সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
হামাস ও পিএর মধ্যে সম্পর্ক
২০০৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর গৃহযুদ্ধে পিএকে সরিয়ে দেয়। আজও গাজা শাসন করছে হামাস, যদিও পশ্চিম তীরে পিএর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের চোখে হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হওয়ায় গাজার শাসনে পিএর ভূমিকা বৃদ্ধি করা আন্তর্জাতিক মহলের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা।
তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কোনো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চান না এবং গাজায় পিএর উপস্থিতিরও বিরোধিতা করছেন।
হুসেন আল-শেখের চ্যালেঞ্জসমূহ
হুসেন আল-শেখ যদি ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে:
- জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা।
- পিএর অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিশ্চিত করা।
- আন্তর্জাতিক সহায়তা অর্জন করা।
- ইসরায়েলের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক সামাল দেওয়া।
- হামাস ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করা।
বিশ্লেষকদের মতে, হুসেন আল-শেখের ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা দিতে পারে, তবে একইসঙ্গে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তার প্রশ্নও তুলতে পারে।
মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বের শেষ পর্যায়ে এসে হুসেন আল-শেখের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে উত্থান ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। তবে শুধু নাম ঘোষণা করলেই নেতৃত্বের সংকট মিটবে না। পিএকে সত্যিকারের জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।
গাজা-পশ্চিম তীরের বিভক্তি মেটানো, আন্তর্জাতিক সমর্থন বজায় রাখা এবং ইসরায়েলি নীতির মুখোমুখি হয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করাই হবে নতুন নেতৃত্বের বড় পরীক্ষা।