পটুয়াখালীতে ধর্ষণের শিকার জুলাই আন্দোলনে শহীদের মেয়ের আত্মহত্যা

পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার পাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নে এক শোকাবহ ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদের কলেজপড়ুয়া কিশোরী মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। শনিবার (২৬ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনা শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্য একটি গভীর প্রশ্ন রেখে গেছে—বিচারহীনতা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব কতটা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে?
ঘটনার পটভূমি
গত ১৮ মার্চ পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার পাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নে এই কিশোরীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ঘটনার পরদিনই পুলিশ সাকিব মুন্সী নামে একজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। তবে পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, এবং অন্যান্য চিহ্নিত অপরাধীরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এই বিচারহীনতার সংবাদে মর্মাহত হয়ে কিশোরী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশ ও ভুক্তভোগীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন কিশোরী তার বাবার কবর জিয়ারতের পর নানাবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। পথে নলদোয়ানী এলাকায় সাকিব ও সিফাত নামে দুজন তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা মুখ চেপে ধরে পাশের জলিল মুন্সির ভিটা বাগানে নিয়ে যান। সেখানে তাকে ধর্ষণ করা হয় এবং ঘটনার ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী কিশোরী দুমকী থানায় দুজনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেছিলেন।
পরিবারের হতাশা ও সমাজের নীরবতা
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে কিশোরী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি বারবার বিচারের আশা করেছিলেন, কিন্তু গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির জামিনে মুক্তি এবং অন্য অপরাধীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার খবর তাকে গভীর হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। পরিবারের একজন সদস্য বলেন, “আমাদের মেয়েটা শুধু তার বাবার জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য গর্ব ছিল। কিন্তু এই সমাজ তাকে বাঁচতে দিল না।”
এই ঘটনা জুলাই আন্দোলনের শহীদদের প্রতি সমাজের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলেছে। জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৮৮১ জন শহীদ হন, যাদের মধ্যে ৫৬৮ জন ছিলেন শিক্ষার্থী। এই আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবি থেকে শুরু করে সরকারের পদত্যাগ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তবে শহীদদের পরিবারের প্রতি সমাজের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও নারীর নিরাপত্তা
এই ঘটনা বাংলাদেশে নারীর নিরাপত্তা এবং বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের জামিনে মুক্তি এবং অন্যান্য অপরাধীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা শুধু ভুক্তভোগীর পরিবারের জন্যই নয়, সমগ্র সমাজের জন্য একটি ভয়াবহ বার্তা দেয়। এটি প্রশ্ন তোলে, আমাদের বিচার ব্যবস্থা কতটা কার্যকরভাবে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে?
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই আন্দোলনে শহীদদের মধ্যে মাত্র ৩০০ জনের স্বজনেরা মামলা দায়ের করেছেন। এটি ইঙ্গিত করে যে অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিচারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এই ঘটনাও তার ব্যতিক্রম নয়।
পুলিশের ভূমিকা ও অভিযোগ
পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পরিবারের অভিযোগ, ঘটনার পর পুলিশ তৎপরতার সাথে একজনকে গ্রেফতার করলেও বাকি অপরাধীদের গ্রেফতারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এছাড়া, গ্রেফতারকৃত সাকিব মুন্সির জামিনে মুক্তির বিষয়টি ভুক্তভোগীকে মানসিকভাবে আরও দ [truncation for brevity].
সমাজের দায়বদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ
এই ঘটনা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের সমাজের গভীর সংকটের প্রতিফলন। নারীর নিরাপত্তা, বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা, এবং শহীদদের পরিবারের প্রতি সমাজের দায়বদ্ধতা—এই সবকিছুই এখন প্রশ্নের মুখে। আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব যে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না? আমাদের সমাজ কীভাবে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানাতে পারে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার, সমাজ, এবং ব্যক্তি—সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। এই কিশোরীর মৃত্যু আমাদের সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে যে, নীরবতা আর নিষ্ক্রিয়তা আর কোনো বিকল্প নয়।