৯ মাসে রপ্তানি শুল্ক আদায়ে প্রবৃদ্ধি ২০০০০%

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের রপ্তানি শুল্ক আদায়ে অভূতপূর্ব ২০,০০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে এত ব্যাপক প্রবৃদ্ধির নজির এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এই অর্জন বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, যদিও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় এখনো পিছিয়ে রয়েছে।
রপ্তানি শুল্ক আদায়ের চিত্র
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি শুল্ক আদায় হয়েছে ৬ কোটি ৩ লাখ টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই খাতে আদায় ছিল মাত্র ৩ লাখ টাকা। এই তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ২০,০০০ শতাংশ, যা রাজস্ব আদায়ের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। তবে, চলতি অর্থবছরের জন্য রপ্তানি শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ কোটি টাকা, যা থেকে এখনো বেশ পিছিয়ে রয়েছে এই খাত।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রপ্তানি শুল্ক থেকে ৭০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৬ কোটি টাকা, যা সংশোধন করে ৬৩ কোটি টাকায় নামানো হয়। কিন্তু গত অর্থবছরে মোট আদায় হয়েছিল মাত্র ৩ লাখ টাকা। এই প্রেক্ষাপটে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হলেও, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
রপ্তানি শুল্ক কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রপ্তানি শুল্ক হলো বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পণ্য রপ্তানির সময় নির্দিষ্ট হারে আরোপিত কর। সাধারণত আমদানি শুল্কের কথাই বেশি শোনা যায়, তবে কিছু নির্দিষ্ট পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও শুল্ক দিতে হয়। এই শুল্কের হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। রপ্তানি শুল্ক প্রযোজ্য পণ্যের তালিকায় রয়েছে ধান-চালের তুষ (ব্র্যান), তুলা বর্জ্য, ইট ও ইটের সামগ্রী, বিভিন্ন ধরনের সিসা ইত্যাদি। এই পণ্যগুলো মূলত ভারত, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করা হয়।
রপ্তানি শুল্ক থেকে আয় সরকারের রাজস্ব খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এটি অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অর্থায়নে সহায়তা করে। তবে, এই খাতে আদায় সাধারণত আমদানি শুল্ক বা ভ্যাটের তুলনায় অনেক কম। এ কারণে এই খাতে এত বড় প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
প্রবৃদ্ধির কারণ কী?
এই অসাধারণ প্রবৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি মূল কারণ কাজ করেছে বলে এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। প্রথমত, চলতি অর্থবছরে রপ্তানি শুল্ক প্রযোজ্য পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। বিশেষ করে, তুলা বর্জ্য এবং ইটের মতো পণ্যের চাহিদা প্রতিবেশী দেশগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, শুল্ক আদায়ে কঠোর তদারকি এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের ফলে আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়া, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে রপ্তানি পণ্যের মূল্য টাকায় বেড়েছে, যা শুল্ক আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে রপ্তানি শুল্ক খাতে আদায় অত্যন্ত নগণ্য ছিল। এই খাতে আদায় বাড়াতে এনবিআর নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে রপ্তানি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং শুল্ক ফাঁকি রোধে কঠোর পদক্ষেপ। এই কৌশলগুলো চলতি অর্থবছরে ফল দিয়েছে, যার ফলে এই খাতে এত বড় প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
যদিও রপ্তানি শুল্ক আদায়ে প্রবৃদ্ধি উৎসাহব্যঞ্জক, তবুও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ কোটি টাকার তুলনায় আদায় হয়েছে মাত্র ৬ কোটি ৩ লাখ টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১৩ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই খাতে আরও বেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো এবং শুল্ক আদায়ের প্রক্রিয়া আরও দক্ষ করা গেলে আদায় আরও বাড়তে পারে।
এছাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এই খাতে প্রভাব ফেলতে পারে। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল, যা রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। তবে, অক্টোবর থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফিরে আসায় রপ্তানি খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অতীতের তুলনা
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে রপ্তানি শুল্ক থেকে মোট ২৫৪ কোটি টাকা আদায় হয়েছিল। এই সময়ে বছরে গড়ে ৩১.৭৫ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। তবে, গত কয়েক বছরে এই খাতে আদায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। চলতি অর্থবছরে এই খাতে আদায় বৃদ্ধি এই খাতের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, “রপ্তানি শুল্ক আদায়ে এত বড় প্রবৃদ্ধি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে, এই খাতে আদায় এখনো খুবই কম। আমাদের রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে এবং শুল্ক আদায়ের প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “এই প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে রপ্তানি খাতে আরও বিনিয়োগ এবং নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন।”
এনবিআরের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “রপ্তানি শুল্ক আদায়ে এই প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হলেও, এটি এখনো সামগ্রিক রাজস্ব আদায়ের খুবই ছোট একটি অংশ। আমদানি শুল্ক এবং ভ্যাটের তুলনায় এই খাতে আদায় অনেক কম। তবে, সঠিক নীতি এবং তদারকির মাধ্যমে এই খাত থেকে আরও বেশি আয় করা সম্ভব।”