ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতি এখন জাপানের চেয়েও বড়

বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। এতদিন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির আসনটি ধরে রেখেছিল জাপান। তবে সর্বশেষ তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া সেই স্থানটি দখল করেছে। ফলে এখন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত।
আইএমএফ ও যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যানালিসিসের (BEA) তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৪১ লাখ কোটি ডলারে। অপরদিকে, জাপানের জিডিপি ছিল ৪ দশমিক শূন্য ১ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৪০ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করছে, ক্যালিফোর্নিয়া অর্থনীতির আকারে জাপানকে ছাড়িয়ে গেছে।
বর্তমানে অর্থনীতির আকার অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম তিন দেশ হলো—
১. যুক্তরাষ্ট্র: ২৯ দশমিক ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার
২. চীন: ১৮ দশমিক ৭৪ ট্রিলিয়ন ডলার
৩. জার্মানি: ৪ দশমিক ৬৫ ট্রিলিয়ন ডলার
এরপরেই রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া, যার প্রবৃদ্ধির গতি জাপানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতির শক্তি
ক্যালিফোর্নিয়া অর্থনৈতিকভাবে এত শক্তিশালী হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- প্রযুক্তি খাত: সিলিকন ভ্যালির মতো বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি অঞ্চল এই অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত, যেখানে গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক (মেটা), টেসলা, নেটফ্লিক্সসহ অসংখ্য শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সদর দপ্তর স্থাপন করেছে।
- বিনোদন শিল্প: হলিউডসহ ক্যালিফোর্নিয়ার বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি বছরে কয়েকশো বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা তৈরি করে, যা এই অঙ্গরাজ্যের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে।
- কৃষি উৎপাদন: যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কৃষি উৎপাদনকারী রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া, বিশেষ করে ফলমূল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে।
- বন্দর ব্যবসা: যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম দুটি সমুদ্রবন্দর—লস অ্যাঞ্জেলেস এবং লং বিচ—ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র।
গভর্নর গ্যাভিন নিউসম ক্যালিফোর্নিয়ার এই সাফল্যকে সামনে এনে গর্ব প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “আমাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী ও শক্তিশালী শিল্প খাত ক্যালিফোর্নিয়াকে আজকের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।”
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ট্রাম্পের নীতির প্রভাব
এই সময়ের প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রশাসনকালে চীনসহ বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে শুল্কারোপ ও বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন। এর প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। তবে ক্যালিফোর্নিয়া এই ধাক্কা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে।
এমনকি গভর্নর নিউসম ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নামেন, বিশেষ করে কৃষি ও প্রযুক্তিখাতে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া ফেডারেল নীতিমালার বিরুদ্ধেও নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়, যা তাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রাখে।
জাপানের পতন: প্রধান কারণগুলো কী?
জাপানের অর্থনৈতিক দুর্বলতার পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:
- জনসংখ্যার সংকট: জাপানে জনসংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমছে। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অনুপাতে তরুণ কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা কমছে এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
- অর্থনৈতিক স্থবিরতা: দীর্ঘদিনের নিম্ন প্রবৃদ্ধি এবং কম মজুরি বৃদ্ধির হার অর্থনীতির গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
- অভ্যন্তরীণ খরচ কমে যাওয়া: ভোক্তাদের ব্যয় সংকুচিত হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমছে, যা জিডিপিতে প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি জাপান শিগগিরই অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন না আনে বা উৎপাদনশীলতাকে বাড়ানোর মতো বড় ধরনের সংস্কার না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও পিছিয়ে পড়তে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর তালিকায় অঙ্গরাজ্য হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার অবস্থান অনেকটাই ব্যতিক্রমধর্মী। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ক্যালিফোর্নিয়া যদি বর্তমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে, তবে সামনের এক দশকে এই অঙ্গরাজ্য নিজস্ব অর্থনৈতিক প্রভাব আরও বাড়াতে সক্ষম হবে।
বিশেষ করে প্রযুক্তি, সবুজ শক্তি (Green Energy), বৈচিত্র্যভিত্তিক ব্যবসা এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার গুরুত্ব আরও বাড়বে। তবে একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, আবাসন সংকট, এবং সামাজিক বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলোকেও।
ক্যালিফোর্নিয়া আজ প্রমাণ করেছে যে উদ্ভাবন, বৈচিত্র্য এবং দৃঢ় নেতৃত্বের সমন্বয়ে একটি অঙ্গরাজ্যও বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। জাপানের জায়গা দখল করে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হওয়া নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এখন প্রশ্ন হলো—এই গতি ধরে রাখতে ক্যালিফোর্নিয়া কতটা সফল হবে, আর জাপান কীভাবে নিজের পুরনো গৌরব ফেরাতে চেষ্টা চালাবে।