বিশ্ব

যুদ্ধ হলে ভারতকে সমর্থন করবে ইসরায়েল

পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—যদি যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তবে তারা ভারতের পাশেই থাকবে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৫ জন ভারতীয় পর্যটক এবং ১ জন নেপালি নাগরিক নিহত হন। এই নির্মম ঘটনার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে বলেছে, সীমান্তপারের সন্ত্রাসীদের পাকিস্তান সরকার মদদ দিচ্ছে। যদিও পাকিস্তান এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে আঞ্চলিক উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে গেছে।

এই প্রেক্ষাপটেই ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন একটি বিবৃতি দেন। রিপাবলিক মিডিয়া নেটওয়ার্কের এক সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়—যদি ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে ইসরায়েল ভারতের পাশে থাকবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতের পাশে আছি। এটি আমাদের নৈতিক অবস্থান। বন্ধু এভাবেই বন্ধুর পাশে থাকে।’

ইসরায়েল-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা

ইসরায়েল ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ক বিদ্যমান। এই সম্পর্ক সামরিক, প্রযুক্তিগত এবং বাণিজ্যিক—তিনটি দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং দীর্ঘদিন ধরেই পারস্পরিক গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানসহ সামরিক সহযোগিতায় যুক্ত রয়েছে।

বিশেষ করে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ইসরায়েলের প্রযুক্তি ও অস্ত্রের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে গত এক দশকে। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নজরদারি প্রযুক্তি—এই সবকিছুতেই ইসরায়েল ভারতকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছে।

পেহেলগাম হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের বার্তা

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একত্রে লড়াইয়ের বার্তা দিয়ে ওরেন মারমোরস্টেইন বলেন, ‘আমরা মনে করি যে, ইসরায়েলের মাটিতে যে হামলা ঘটে, তার সঙ্গে এই হামলার অনেকটাই মিল রয়েছে। পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন, কিন্তু হত্যাযজ্ঞ একই। নির্দোষ অসামরিক নাগরিকদের উপর জিহাদি উগ্রবাদী মানসিকতার সন্ত্রাসী আক্রমণ কেমন তা আমরা গভীরভাবে বুঝি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারত আমাদের বন্ধু। এই সম্পর্কটি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি যখন উগ্র সন্ত্রাসীরা আপনার মানুষকে লক্ষ্য করে, তখন কী অনুভব হয়। ইসরায়েল ভারতের পাশে ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।’

এই বক্তব্য কেবল একটি রাজনৈতিক সংহতির বার্তা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ইসরায়েলের কৌশলগত অবস্থানও স্পষ্ট করে তোলে। এটি ভবিষ্যৎ সামরিক ও কূটনৈতিক অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার বর্তমান প্রেক্ষাপট

পেহেলগাম হামলার পর ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান কখনোই দুর্বল হবে না। আমরা আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেব।’ যদিও ভারতের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তবে সীমান্তে সেনা মোতায়েন জোরদার করা হয়েছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তান এই হামলার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকার কথা জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ভারতের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা নিজ ভূখণ্ডে সন্ত্রাস দমনে বদ্ধপরিকর।’

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

ইসরায়েলের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ পেহেলগাম হামলার নিন্দা জানালেও ইসরায়েল সরাসরি ভারতের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. অনুপম সেন বলেন, ‘ইসরায়েলের এই বার্তা কেবল বন্ধুত্বের প্রকাশ নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত বার্তা। ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক যে কতটা গভীর, তা এই অবস্থানের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।’

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ অবস্থান

ভারত ও ইসরায়েল উভয় দেশই দীর্ঘদিন ধরে জিহাদি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। উভয় দেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, নিরাপত্তা হুমকি এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কৌশলের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।

ইসরায়েলের মতো ভারতও নানা সময়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। তাই সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সহযোগিতা তাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, ‘ভারত ও ইসরায়েল একই রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তাই আমাদের একত্রে লড়াই করতে হবে।’

ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট

যদি সত্যি কোনো সামরিক উত্তেজনা চূড়ান্ত আকার নেয়, তাহলে ইসরায়েলের এই সমর্থন ভারতের জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যদিও সরাসরি কোনো সামরিক সহায়তার সম্ভাবনা এখনো নেই, তবে কূটনৈতিক সমর্থন এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

অপরদিকে, এই বার্তার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-পাকিস্তান জোটের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার নতুন কৌশলগত দিকও উন্মোচিত হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button