চলতি বছর দেশে আরো ৩০ লাখ মানুষ ‘অতি গরিব’ হতে পারে

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধীরগতি, শ্রমবাজারের দুর্বলতা এবং প্রকৃত আয়ের হ্রাস—এই সবকিছু মিলিয়ে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস: অতি গরিবদের সংখ্যা বাড়ছে
বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য সীমা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির দৈনিক আয় যদি ২ দশমিক ১৫ মার্কিন ডলারের কম হয়, তবে তাকে ‘হতদরিদ্র’ বা ‘অতি গরিব’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশে এই শ্রেণিভুক্ত মানুষের হার ছিল ৫ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে।
এটি অর্থনীতির এক ভয়াবহ বার্তা বহন করে। এই হিসাব অনুযায়ী, দেশে নতুন করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। একদিকে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে আয়হীনতা ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি মিলিয়ে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
জাতীয় দারিদ্র্য হারেও ঊর্ধ্বগতি
শুধু অতি দারিদ্র্য নয়, জাতীয় দারিদ্র্য হারেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের হিসাবে জাতীয় দারিদ্র্য হার ছিল প্রায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে ২০২৫ সালে এটি বাড়তে পারে ২২ দশমিক ৯ শতাংশে। অর্থাৎ দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ জনগণ সরাসরি দারিদ্র্যের প্রভাবভুক্ত হতে পারেন।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। মূল্যস্ফীতির চাপ এবং কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা এই অবনতির জন্য দায়ী। বিশেষ করে দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক ও খাতভিত্তিক অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ অবস্থা বেশি প্রকট।
শ্রমবাজারে দুর্বলতা, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরেও দেশের শ্রমবাজারে স্থবিরতা অব্যাহত থাকবে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসবে এবং বেকারত্বের হার বাড়তে পারে। করোনা মহামারির পরে যেভাবে শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে উৎপাদন ও রপ্তানি খাতেও চাহিদা কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নিয়োগ দিতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যমান কর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে বা আংশিক সময়ের চুক্তিতে কাজ করানো হচ্ছে, যা প্রকৃত আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখিতা
বিশ্বব্যাংকের অপর একটি প্রতিবেদন—‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট: ট্যাক্সিং টাইমস’—এ বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। এই হার ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে পূর্বাভাস দেওয়া ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির চেয়েও কম।
তবে আগামী অর্থবছরের জন্য কিছুটা আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এ ধীর গতি সরাসরি কর্মসংস্থান, আয় ও ভোগব্যয়ের ওপর প্রভাব ফেলে। যখন সাধারণ মানুষ আয় কমে যাওয়ার ফলে কম ব্যয় করে, তখন বাজারে চাহিদা হ্রাস পায় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে—বৈষম্য বৃদ্ধির আশঙ্কা। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয় ও সম্পদের পার্থক্য দিন দিন বাড়ছে। যেসব পরিবার আগে দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি ছিল, তারা এখন সরাসরি অতি দারিদ্র্যের কাতারে চলে যাচ্ছে।
এছাড়া, শহর ও গ্রামের মধ্যে দারিদ্র্যের পার্থক্যও বাড়ছে। শহরাঞ্চলে শ্রমিকরা কমপক্ষে ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন, কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের অভাব এবং কৃষি খাতের দুর্বলতা দরিদ্রদের অবস্থানকে আরও শোচনীয় করে তুলছে।
সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের করণীয়
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখনই সময় উপযুক্ত নীতিগত হস্তক্ষেপের। সরকারকে অবশ্যই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। বিশেষ করে নগদ সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবায় বেশি বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া, শ্রমবাজারকে চাঙ্গা করতে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ, কর ছাড় এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি জোরদার করার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, কর্মসংস্থান বাড়ানো ছাড়া দারিদ্র্য হ্রাসের দীর্ঘমেয়াদি কোনো পথ নেই।