বানিজ্য

টানা ৯ দিন ক্রমাগত নামছে শেয়ারের সূচক

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে চলমান মন্দা পরিস্থিতি নতুন এক দুঃসময়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। টানা নয় কার্যদিবস ধরে মূল্যসূচকের পতন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে। বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স নেমে এসেছে ৪,৯৭২ পয়েন্টে, যা গত কয়েক মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থান। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখন বিরাজ করছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও আস্থার সংকট।

সূচকের লাগাতার পতন: আশঙ্কাজনক ধারাবাহিকতা

বাজার বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, বাজারে যে দীর্ঘমেয়াদি চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। গত ৯ কার্যদিবসে সূচক কমেছে প্রায় ৩০০ পয়েন্টের মতো, যা দেশের শেয়ারবাজারের সামগ্রিক অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এদিন সূচকের শুরুটা কিছুটা ইতিবাচক ছিল। লেনদেন শুরুর প্রথম ১৫ মিনিটে সূচক ৮ পয়েন্ট বেড়ে আশাব্যঞ্জক বার্তা দিলেও, এর পরপরই বাজার ধসে পড়তে শুরু করে।

দিবস শেষে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৪৯.৮৭ পয়েন্ট, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য আরেকটি হতাশাজনক বার্তা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পতনের পিছনে রয়েছে কয়েকটি প্রধান কারণ—রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি আস্থার অভাব।

লেনদেনে অদ্ভুত উত্থান, তবে নিম্নমুখী শেয়ারের আধিক্য

অন্যদিকে, সূচকের পতনের বিপরীতে দিনটিতে লেনদেনে কিছুটা উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। বৃহস্পতিবার ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৩৬৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার, যা আগের দিনের তুলনায় প্রায় ৬৭ কোটি টাকা বেশি। অনেকেই এই প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি হয়তো কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উপর কেন্দ্রিক লেনদেন, যা সামগ্রিক বাজার অবস্থার প্রতিফলন নয়।

এই দিনে মোট ৩৯৮টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড লেনদেনে অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩০০টির শেয়ার দর কমেছে, মাত্র ৫২টির শেয়ার দর বেড়েছে, আর ৪৬টির দর অপরিবর্তিত ছিল। এমন চিত্র সাধারণত একটি দুর্বল ও আস্থাহীন বাজারকে নির্দেশ করে।

সর্বোচ্চ লেনদেনকারী কোম্পানি ও দর বৃদ্ধির শীর্ষে যারা

বৃহস্পতিবারের বাজারে লেনদেনের দিক থেকে বিচ হ্যাচারি শীর্ষে ছিল, যার পরেই রয়েছে ফাইন ফুডস এবং ব্র্যাক ব্যাংক। এই কোম্পানিগুলোতে সক্রিয় লেনদেন দেখা গেলেও, অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

দর বৃদ্ধির দিক থেকে এনার্জি প্যাক পাওয়ার প্রথম স্থানে রয়েছে, যার শেয়ার দর একদিনে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এরপর রয়েছে তাকাফুল ইসলামি ইন্স্যুরেন্স এবং প্রভাতি ইন্স্যুরেন্স। তবে এই সংস্থাগুলোর দরবৃদ্ধি সামগ্রিক বাজারের প্রেক্ষাপটে একক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও একই অবস্থা

শুধু ঢাকায় নয়, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-এর চিত্রও ছিল একইরকম। সার্বিক সূচক কমেছে ৫৪ দশমিক ৩৭ পয়েন্ট, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১৩,৯৫৬ পয়েন্টে। সিএসইতে এদিন মোট ৭ কোটি ১৩ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে, যা সাম্প্রতিককালে তুলনামূলকভাবে কম।

বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ মনে করছেন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ঘাটতি এই পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। অনেকেই হঠাৎ করেই শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, যার ফলে বাজারে চাহিদা সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতামত

বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা ফেরাতে হলে প্রথমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর আরও সক্রিয় ভূমিকা দরকার।

অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজুল করিম বলেন, “বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার ও বিএসইসিকে একসাথে কাজ করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা এবং বাজারে স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত না করলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না।”

তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের অনুপস্থিতি এবং পুরনোদের শঙ্কিত মনোভাবই বোঝাচ্ছে যে পলিসি লেভেলে বড় ধরনের সংস্কার দরকার।”

বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ ও প্রত্যাশা

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকে গত কয়েকদিনের ধারাবাহিক পতনে বড় অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই শেয়ারবাজার ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন।

বিনিয়োগকারী ফরহাদ হোসেন বলেন, “প্রতিদিন বাজার খুললে মনে হয় আরও কত টাকা হারাবো। কোথাও কোনো স্থিতিশীলতা নেই। সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকেও কোনো আশ্বাস পাচ্ছি না।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button