নাফ নদীতে বাংলাদেশি জেলে অপহরণ, মিয়ানমারের আরাকান আর্মি

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদী থেকে আবারও দুই বাংলাদেশি জেলে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বগার দ্বীপ এলাকায় মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’র (AA) সদস্যরা এ অপহরণ করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
অপহৃত দুই জেলে হলেন হোয়াইক্যংয়ের বালুখালীর আবদুল হাকিমের ছেলে বাদশা আলম (৪৫) ও রশিদ আহমেদের ছেলে আবুল কালাম (৪০)। গতকাল বুধবার দুপুরে নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে তাঁরা অপহরণের শিকার হন। স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অস্ত্রের মুখে নৌকা থেকে অপহরণ
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে সিরাজুল মোস্তফা বলেন, “দুপুরে জেলেরা মাছ ধরার জন্য নৌকা নিয়ে নদীতে যান। তখন হঠাৎ মিয়ানমার থেকে আসা আরাকান আর্মির সদস্যরা তাঁদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তুলে নিয়ে যায়।” ঘটনার পর পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক জেলে মাছ ধরতে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
নাফ নদী এখন ‘অপহরণের নদী’?
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ মাহাফুজুর রহমান বলেন, “নাফ নদীতে গেলেই মনে হয়, কখন কারা তুলে নিয়ে যায়। আরাকান আর্মির তৎপরতা এখন প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে।” তাঁর মতে, সীমান্ত এলাকায় এই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশি জেলেদের জীবিকা ও নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তুলছে।
বিজিবি’র বক্তব্য: মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল
নাফ নদীর ওই এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা উখিয়ার ৬৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, “সেখানে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তারপরও জেলেরা গিয়েছিলেন বলেই হয়তো এমন ঘটনা ঘটেছে।” তিনি আরও জানান, এখনো ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ আসেনি, তবে বিজিবি বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
প্রশাসনের অবস্থান
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, “ঘটনার বিষয়ে অবগত হয়েছি। খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।”
আরাকান আর্মি: সীমান্তে এক নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকি
আরাকান আর্মি মূলত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সক্রিয় একটি বিদ্রোহী সংগঠন। ২০২৪ সাল থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠনটি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের অপহরণের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে।
সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, অনেক সময় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিষেধাজ্ঞার কথা বললেও সেই নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অনেক জেলে অবগত নন। ফলে তাঁরা অসাবধানতাবশত সীমান্ত পার হয়ে যান এবং অপহরণের শিকার হন।
প্রশ্ন উঠছে: সীমান্তে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নীতি কতটা কার্যকর?
সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এমন অপহরণ বারবার ঘটলেও এখনো পর্যন্ত জোরালো কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কার্যকর হতে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার করে এবং সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়িয়ে এই হুমকি মোকাবিলা করা জরুরি।
একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণকে সতর্ক করা, সীমান্তে ডিজিটাল নজরদারির ব্যবস্থা ও কমিউনিটি অ্যালার্ট সিস্টেম চালু করাও এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বারবার জেলে অপহরণের ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। এমন ঘটনা প্রতিহত করতে হলে শুধু নিরাপত্তা বাহিনী নয়, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, এবং কূটনৈতিক মহলের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।