অর্থনীতি

নয়াদিল্লি শুল্কে অনিচ্ছুক, চলছে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা নিয়ে চলমান আলোচনা এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নতুন বাণিজ্য চুক্তির টার্মস অব রেফারেন্স (ToR) বা মূল শর্তাবলি চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আজ থেকে ওয়াশিংটনে শুরু হচ্ছে দুই পক্ষের প্রতিনিধিদের আনুষ্ঠানিক আলোচনা।

নতুন চুক্তির মূল বিষয়বস্তু কী?

হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চূড়ান্ত হওয়া টার্মস অব রেফারেন্সে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—

  • দ্বিপক্ষীয় শুল্ক ও কর কাঠামো
  • অশুল্ক বাধা দূরীকরণ
  • উৎসবিধি (Rules of Origin)
  • শুল্কায়ন ও বাণিজ্য সহজীকরণ

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বর্তমানে ভারত সফরে রয়েছেন। তাঁর এই সফরেই চুক্তির শর্তাবলি চূড়ান্ত হলো। এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক কেবল বাণিজ্যিক নয়, ভূরাজনৈতিক অবস্থানকেও প্রভাবিত করে।

ট্রাম্প যুগের শুল্কনীতি: পেছনের গল্প

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার ভারতের উচ্চ শুল্কহারের সমালোচনা করেছেন। তিনি একাধিকবার ভারতকে ‘শুল্কের রাজা’ বলে অভিহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ভারতে তাদের রপ্তানিকৃত পণ্যে গড় শুল্কহার প্রায় ১৭ শতাংশ, যা বিশ্বের অন্যান্য বড় অর্থনীতির তুলনায় অনেক বেশি।

২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে ভারতসহ বেশ কিছু দেশের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর যথাক্রমে ২৫% ও ১০% আমদানি শুল্ক আরোপ করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ২০১৯ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ২৮টি পণ্যে শুল্ক আরোপ করে, যার মধ্যে কাঠবাদাম, আপেল, ও আঙুরের মতো পণ্যও ছিল।

২০২০ সালে দু’পক্ষ আপসে পৌঁছায় এবং একপর্যায়ে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ২০২৪ সালে ট্রাম্প পুনরায় শুল্ক আরোপ করেন, যা আবারও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি করে।

আলোচনার কেন্দ্রে কোন পণ্যগুলো?

ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম হচ্ছে এই আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, আজ ওয়াশিংটনে শুরু হওয়া বৈঠকে এই দুটি পণ্যের ওপর ট্রাম্পের আমলে আরোপিত শুল্ক নিয়ে মূল আলোচনা হবে।

২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানি থেকে আয় ছিল প্রায় ৪৫ কোটি ডলার। এই খাত রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ভারত চায় এই শুল্ক তুলে নেওয়া হোক।

ভারত কী করছে শুল্ক কমাতে?

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় ভারত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেমন:

  • যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা কৃষিপণ্যের (যেমন কাঠবাদাম, ক্র্যানবেরি) ওপর শুল্ক হ্রাস
  • ইন্টারনেট ভিত্তিক বিজ্ঞাপনের ওপর ৬% করারোপ বাতিল (যা মূলত Google, Meta ও X-এর ওপর আরোপিত ছিল)
  • হারলে ডেভিডসন-এর মতো যুক্তরাষ্ট্রের মোটরসাইকেলে শুল্ক কমিয়ে আনা
  • ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে গড় আমদানি শুল্ক ১৭% থেকে কমিয়ে ১০.৬৬% করা

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জিতিন প্রসাদ লোকসভায় জানান, ২০২৩ সালে ভারতের সরল গড় শুল্কহার ছিল ১৭%। বর্তমানে তা ১০.৬৬%-এ নামিয়ে আনা হয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সহজ করতে নয়াদিল্লির রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে।

কেন এই আলোচনায় আগ্রহী দুই দেশ?

দুই দেশেরই এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার পেছনে রয়েছে যৌথ স্বার্থ। যুক্তরাষ্ট্র চায়:

  • ভারতীয় বাজারে পণ্যের প্রবেশাধিকার আরও সহজ করা
  • যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ও উৎপাদন খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা
  • বাণিজ্য ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা

অন্যদিকে ভারত চায়:

  • নিজস্ব পণ্য বিশেষ করে প্রযুক্তি, বস্ত্র, কৃষিপণ্য এবং ধাতু খাতে রপ্তানি বাড়াতে
  • প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে
  • ভূরাজনৈতিক কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছাকাছি যেতে

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রির বলেন, “চলমান আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে শ্রমিক, কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। ভারত গঠনমূলকভাবে এগিয়ে আসছে, যা ইতিবাচক।”

বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যে ভারতের উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৮০ কোটি ডলার (৪১.১৮ বিলিয়ন), যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এই ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উদ্বেগের কারণ।

দুই দেশ যদি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য কাঠামো তৈরি করতে পারে, তবে এই উদ্বৃত্তের চাপও কিছুটা কমানো সম্ভব।

চুক্তির সম্ভাব্য প্রভাব

যদি আলোচনার ফলাফল ইতিবাচক হয় এবং একটি নতুন চুক্তি চূড়ান্ত হয়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে:

  • পণ্যের দাম কমবে উভয় দেশে
  • রপ্তানি বাড়বে বিশেষ করে প্রযুক্তি, কৃষি ও গার্মেন্ট খাতে
  • চীনবিরোধী সরবরাহ চেইন গড়ে তোলায় সহায়ক হবে
  • উদ্যোক্তারা পাবেন নতুন বাজার ও যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ

যুক্তরাষ্ট্র–ভারত বাণিজ্য আলোচনা নতুন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দরজা খুলে দিতে পারে। যদিও আলোচনা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে, তবে ইতিবাচক মনোভাব ও গঠনমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুই দেশই একটি সমঝোতার দিকে এগোচ্ছে। যদি এই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বাণিজ্যিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটি হবে চীনের বিকল্প হিসেবে ভারতকে এগিয়ে নেওয়ার বড় সুযোগ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button