গাড়ি উৎপাদনে বাংলাদেশে নতুন দিগন্ত গাজীপুরে

বাংলাদেশের অটোমোবাইল শিল্পে এক নতুন যুগের সূচনা হলো। গাজীপুরের কাশিমপুরের ভবানীপুর গ্রামে অবস্থিত র্যানকন অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় এখন থেকে তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক গাড়ি। এসব গাড়ির মধ্যে রয়েছে জাপানের বিশ্বখ্যাত মিতসুবিশি এবং মালয়েশিয়ার জনপ্রিয় ব্র্যান্ড প্রোটনের গাড়ি।
এক সময় যেখানে শুধুমাত্র বিদেশ থেকে আনা গাড়ির যন্ত্রাংশ সংযোজন হতো, এখন সেখানে গাড়ির কাঠামো প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে রং করা, ইঞ্জিন সংযোজন এবং আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষা পর্যন্ত সব কাজ করা হচ্ছে দেশে। এ উদ্যোগ দেশের অর্থনীতির জন্য যেমন ইতিবাচক, তেমনি প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ক্ষেত্রেও এক বড় অগ্রগতি।
গাজীপুরে গাড়ি তৈরির কেন্দ্র—র্যানকন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক
র্যানকন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, গাজীপুরে ৫৭ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই আধুনিক শিল্প এলাকা। এখানে তিনটি পৃথক উৎপাদন কারখানা রয়েছে—র্যানকন মোটরবাইক, র্যানকন ইলেকট্রনিকস এবং র্যানকন অটো ইন্ডাস্ট্রিজ। র্যানকন মোটরবাইকে সুজুকির মোটরসাইকেল, র্যানকন ইলেকট্রনিকসে তোশিবা, এলজি ও স্যামসাংয়ের টিভি-ফ্রিজ তৈরি হয়।
র্যানকন অটো ইন্ডাস্ট্রিজে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে:
- মিতসুবিশি এক্সপেন্ডার (৭ আসনের এমপিভি)
- প্রোটন এক্স-৭০ (৫ আসনের এসইউভি)
- জ্যাক পিকআপ ট্রাক (চীনা ব্র্যান্ড)
- মার্সিডিজ বেঞ্জ বাস (জার্মান প্রযুক্তিতে)
এই কারখানায় বর্তমানে কাজ করছেন প্রায় ৮০০ কর্মী। ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগে আধুনিকায়ন
গত এক বছরে কারখানার কাঠামো ও উৎপাদন লাইনে আধুনিকায়ন আনতে র্যানকন কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। যুক্ত করা হয়েছে বিশ্বমানের রোবটিক ওয়েল্ডিং, পেইন্টিং বুথ, এসেম্বলি লাইন ও টেস্ট ট্র্যাক।
এই উন্নত পরিকাঠামোর মাধ্যমে এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের গাড়ি, যা বাংলাদেশে উৎপাদিত হলেও মানে কোনো আপস নেই।
দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের টেস্ট ট্র্যাক
গাড়ির গুণগত মান নিশ্চিত করতে র্যানকন অটো ইন্ডাস্ট্রিজ তৈরি করেছে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ টেস্ট ট্র্যাক। এখানে প্রতিটি গাড়ির:
- গতি,
- ব্রেকিং,
- হ্যান্ডলিং,
- সাসপেনশন,
- স্থিতিশীলতা এবং
- জ্বালানী দক্ষতা
পরীক্ষা করা হয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে।
এ ধরনের পরীক্ষার ফলে ক্রেতারা নিশ্চিন্তে গাড়ি কিনতে পারবেন এবং রপ্তানির ক্ষেত্রেও সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।
গাড়ির উৎপাদন ক্ষমতা
র্যানকন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে তাদের কারখানায় বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা নিম্নরূপ:
- মিতসুবিশি এক্সপেন্ডার: ২০০০ ইউনিট
- প্রোটন এক্স–৭০: ৩০০–৪০০ ইউনিট
- জ্যাক পিকআপ ট্রাক: ৬০০ ইউনিট
- মার্সিডিজ বেঞ্জ বাস: ৩৬০ ইউনিট
এ ছাড়াও ২০২৬ সালের মধ্যে ৪টি ব্যক্তিগত ও ২টি বাণিজ্যিক মডেল যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
জুনে শুরু বাণিজ্যিক বিক্রি
বর্তমানে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চললেও, ২০২৫ সালের জুন মাসে মিতসুবিশি এক্সপেন্ডার ও প্রোটন এক্স-৭০ মডেলের আনুষ্ঠানিক বিক্রি শুরু হবে।
প্রোটন এক্স-৭০:
- পাঁচ আসনের এসইউভি
- আধুনিক প্রযুক্তি ও কম খরচে রক্ষণাবেক্ষণ
- মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামে অন্যতম জনপ্রিয়
মিতসুবিশি এক্সপেন্ডার:
- সাত আসনের এমপিভি
- মাল্টিপারপাস ইউজ (পণ্য ও যাত্রী পরিবহন)
- ১৫০০ সিসির ইঞ্জিন, জ্বালানি খরচ প্রতি লিটারে ৮-৯ কিমি
- পাঁচ বছরের ওয়ারেন্টি সুবিধা
বাংলাদেশে গাড়ি উৎপাদনের ভবিষ্যৎ
র্যানকন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভবিষ্যতে ব্রিটিশ ব্র্যান্ড এমজি (MG) গাড়ির সংযোজনের পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় গাড়ির উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা ও ট্যাক্স ছাড় সুবিধা থাকলে আরও বিদেশি ব্র্যান্ডকে আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।
গাড়ি শিল্পে বাংলাদেশের অগ্রগতি
বাংলাদেশে প্রতিবছর ব্যক্তিগত গাড়ির চাহিদা প্রায় ৩০,০০০ ইউনিটের মতো। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই আমদানি নির্ভর। স্থানীয় উৎপাদন শুরু হলে:
- আমদানি খরচ কমবে,
- দেশের রিজার্ভ সংরক্ষিত থাকবে,
- কর্মসংস্থান বাড়বে,
- কারিগরি দক্ষতা বাড়বে,
- ভোক্তা পর্যায়ে দাম সাশ্রয়ী হবে।
চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, স্থানীয়ভাবে গাড়ি উৎপাদন এক দেশকে শিল্পায়িত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে।
বাংলাদেশে এখন আর শুধু পোশাকশিল্প নয়, গাড়ি শিল্পেও বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলছে। র্যানকনের মত প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন উদ্যোগ দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে আরও মজবুত করবে এবং ভবিষ্যতে দেশীয় গাড়ি রপ্তানির পথও সুগম করবে। এ যেন আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণের আরেক ধাপ।