ড. ইউনূস মামলা বাতিল, আপিলে বড় জয়

বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা অর্থপাচার মামলার অভিযোগ গঠন আদেশ বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ আজ বুধবার এই ঐতিহাসিক রায় দেন।
এ রায়ে উচ্চ আদালত বলেছে, হাইকোর্টের আগের রায়ের বিরুদ্ধে ড. ইউনূসের আপিল গ্রহণযোগ্য এবং তা মঞ্জুরযোগ্য। একইসঙ্গে মামলার তড়িঘড়ি করে প্রত্যাহার এবং অভিযোগ গঠনের সিদ্ধান্ত যথাযথ ছিল না বলেও মন্তব্য করেছেন আদালত।
মামলার পটভূমি: কীভাবে শুরু হয়েছিল এই বিতর্ক?
২০২৩ সালের ৩০ মে দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযোগ আনা হয়, ড. ইউনূস ও আরও ১৩ জন মিলে ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এ বিচারাধীন ছিল।
২০২৪ সালের ১২ জুন আদালত ওই মামলায় ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এর পরেই মামলাটি আইনি বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসে। ড. ইউনূস এই অভিযোগ গঠন ও মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন, যেখানে তিনি দাবি করেন, এই মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এতে আইনের অপব্যবহার হয়েছে।
হাইকোর্টের রায় ও আপিল বিভাগের হস্তক্ষেপ
হাইকোর্ট গত বছরের ২৪ জুলাই ড. ইউনূসের আবেদন খারিজ করে দেয়। পরে তিনি আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হন। আজকের রায়ে আপিল বিভাগ সেই হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত বাতিল করে ড. ইউনূসের আবেদন মঞ্জুর করে।
আদালত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে যে, “মানি লন্ডারিং আইনের প্রাথমিক শর্ত পূরণ ছাড়াই মামলা দায়ের করা হয়েছিল। অভিযোগ গঠন পর্যায়েও প্রয়োজনীয় নথিপত্র এবং উপযুক্ত তদন্তের অভাব ছিল।”
মামলার আইনি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ড. ইউনূস শুধু একজন নোবেল বিজয়ী নন, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশি উন্নয়ন চিন্তার এক উজ্জ্বল মুখ। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা আন্তর্জাতিক মহলেও নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। বহু মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব তাকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেন।
এছাড়া, তিনি সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন যে, তার বিরুদ্ধে মামলাটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যদিও সরকার পক্ষ বারবার বলেছে, মামলাটি দুদকের নিজস্ব তদন্তের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
মামলার প্রভাব: ব্যক্তিগত সুনাম ও অর্থনৈতিক পরিবেশ
এই মামলা শুধু ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সুনামের ওপরই নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ ও ব্যবসা পরিবেশের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা এবং বিনিয়োগকারী এ ধরনের মামলাকে “ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের জন্য হুমকি” বলে অভিহিত করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মামলা বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় স্বতন্ত্রতা ও ন্যায়বিচারের সংস্কৃতির প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা বাড়বে।
প্রতিক্রিয়া: কী বললেন সংশ্লিষ্টরা?
ড. ইউনূস রায় ঘোষণার পর বলেন,
“আমি বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রেখেছিলাম এবং আজকের রায়ে সেই আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি সবসময় আইন মেনে চলেছি এবং মানবিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছি।”
দুদক এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি, তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা পূর্ণ রায়ের কপি হাতে পেলে পরবর্তী আইনি করণীয় নির্ধারণ করবেন।
আইনজীবীরা বলছেন, এই রায় ভবিষ্যতে অনুরূপ মামলার জন্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করবে।
ভবিষ্যৎ প্রভাব ও বিশ্লেষণ
ড. ইউনূসের মামলা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। মামলা বাতিল হওয়ায় অনেকেই এটিকে “ন্যায়বিচারের বিজয়” হিসেবে দেখছেন। অপরদিকে, সরকারের কিছু সমর্থক মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে দুর্নীতি দমনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রায়ে দুদকের মামলার দায়ের ও তদন্ত প্রক্রিয়ার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আদালত। ফলে, ভবিষ্যতে দুর্নীতির মামলা করতে গেলে আরও বেশি স্বচ্ছতা ও প্রমাণ দরকার হবে।