এ বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৮% হতে পারে: আইএমএফ

চলতি বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ধীরগতির হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। মঙ্গলবার রাতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের যৌথ বসন্তকালীন সভার দ্বিতীয় দিনে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক, এপ্রিল ২০২৫’ প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে আইএমএফ প্রতিবছর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত প্রতিষ্ঠানটি পঞ্জিকাবর্ষ অনুসারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়। সেই অনুযায়ী ২০২৫ সালের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ধরা হয়েছে ৩.৮ শতাংশে, যা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সংশোধিত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা আইএমএফের তুলনায় অনেক বেশি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বছর প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছাবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত
আইএমএফ শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, মূল্যস্ফীতির দিকেও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টি দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে চলতি বছর গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। এটি দেশের সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত এক বছরের গড় মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর মানে দাঁড়ায়, দেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল জীবনের মুখোমুখি হচ্ছেন। খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি ব্যয়, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট—এসবই মূল্যস্ফীতির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এডিবির পূর্বাভাস ও বাস্তবতার মিল
এর আগে চলতি মাসেই আরেক আন্তর্জাতিক সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানায়, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ, আইএমএফের পূর্বাভাসের তুলনায় সামান্য বেশি। তবে দুটি সংস্থার পূর্বাভাসেই একটি বিষয় স্পষ্ট—বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
বেসরকারি অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈশ্বিক মন্দা, বৈদেশিক রিজার্ভ সংকট, আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্যহীনতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং প্রবাসী আয় হ্রাসের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ, আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল নীতিমালা অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিচ্ছে।
আগামীর আশা ও আইএমএফের দীর্ঘমেয়াদি মূল্যায়ন
তবে আশার আলোও রয়েছে। আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং ৬ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এর মানে দাঁড়ায়, চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, নীতিগত স্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক সহায়তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে প্রবৃদ্ধির গতি আবারো ফিরে আসতে পারে।
আইএমএফের মতে, বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব কাঠামোগত সংস্কারে অংশ নিচ্ছে—বিশেষ করে ব্যাংক খাত সংস্কার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উদ্যোগ—তা যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে।
ঋণ কর্মসূচি ও ভবিষ্যৎ আলোচনা
বাংলাদেশ বর্তমানে আইএমএফের সঙ্গে একটি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচিতে যুক্ত রয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় এখন পর্যন্ত কয়েক কিস্তিতে অর্থ ছাড় করা হয়েছে। বর্তমানে এই কর্মসূচির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় নিয়ে আলোচনা চলছে। বসন্তকালীন এই সম্মেলনে আইএমএফের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশের ১৫ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দল এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছে।
এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। আলোচনা সফল হলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নতুন কিস্তির অর্থ ছাড় হতে পারে, যা অর্থনীতিকে কিছুটা স্বস্তি দেবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
আইএমএফের প্রতিবেদনে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিরও বিশ্লেষণ রয়েছে। ২০২৫ সালে বৈশ্বিক গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো—বিশেষ করে ভারত ও ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে বেশি হবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে চাপের মুখে থাকলেও ভবিষ্যতে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী নীতিগত সিদ্ধান্ত, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
উপসংহার
আইএমএফের নতুন এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের জন্য যেমন বাস্তবতা তুলে ধরেছে, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকার সতর্ক বার্তাও দিয়েছে। অর্থনীতির গতি শ্লথ হলেও সেটিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে, যদি সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কাঠামোগত সংস্কার ও স্থায়ী সমাধানে আন্তরিক হয়। এখন সময় পরিকল্পিত, স্বচ্ছ ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার।