বাংলাদেশে চাল আমদানি বন্ধে ভারতের পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ দাম কমেছে ১৬ শতাংশ

বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে চাল আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পর ভারতের পূর্বাঞ্চলজুড়ে চালের বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। গত ১০ দিনের মধ্যে জনপ্রিয় আধাসিদ্ধ মিনিকেট চালের দাম কেজিপ্রতি ৬২ রুপি থেকে নেমে এসেছে ৫৩ রুপিতে, অর্থাৎ প্রায় ১৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে রপ্তানি বন্ধের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয়ভাবে বাম্পার ধানের ফলনও এই দাম পতনের অন্যতম কারণ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিস্থিতি এমন থাকলে চালের দাম আরও কমতে পারে।
বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের প্রভাব
গত ১৫ এপ্রিল থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় চাল আমদানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আমদানি বন্ধ থাকবে। বেনাপোল বন্দরের পরিচালক গণমাধ্যমকে জানান, সরকারিভাবে নেওয়া এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সীমান্তের দুই পাশে স্পষ্টভাবে পড়তে শুরু করেছে।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে দেশের বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৯২টি প্রতিষ্ঠানকে ভারত থেকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এদের মাধ্যমে ২ লাখ ৭৩ হাজার টন সেদ্ধ চাল এবং ১ লাখ ১৯ হাজার টন আতপ চাল আমদানি করার কথা ছিল। ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে ভারতীয় চাল আমদানির গতি বাড়ে এবং জানুয়ারির শুরুতে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে।
বেসরকারিভাবে চাল আমদানি এবং নতুন সংকট
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টন আধাসিদ্ধ মিনিকেট চাল আমদানির অনুমতি দেয়। আগে এসব আমদানি শুধুমাত্র সরকারি পর্যায়ে হতো। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বাংলাদেশ দ্রুত আমদানি শুরু করে, যা স্থানীয় বাজারে চালের দাম বাড়ায়।
ভারতের চাল রপ্তানিকারক সংস্থা হাল্ডার ভেঞ্চারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেশব কুমার হালদার বলেন, “বেসরকারি আমদানি শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশে সরবরাহ বেড়ে যায় এবং ভারতের বাজারে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে। এখন সেই চাহিদা হঠাৎ বন্ধ হওয়ায় ভারতীয় বাজারে বাড়তি সরবরাহ তৈরি হয়েছে, যার ফলে দামে পতন ঘটেছে।”
চাল রপ্তানিকারকদের প্রতিক্রিয়া
ভারতের চাল রপ্তানিকারক ও রাইসভিলার সিইও সুরজ আগরওয়াল বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ একা বছরে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টন আধাসিদ্ধ মিনিকেট চাল উৎপাদন করে। বাংলাদেশ ছিল এই উৎপাদনের অন্যতম প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। পেট্রাপোল-বেনাপোল বন্দর দিয়ে এই চাল পরিবহন করা হতো, যা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য কম খরচে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে সরবরাহ নিশ্চিত করত।”
তিনি আরও বলেন, “জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মিনিকেট চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৫ রুপি থেকে বেড়ে ৬২ রুপি পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ আমদানি বন্ধ করায় বর্তমানে সেই চাহিদা নেই। ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে এবং দাম কমতে শুরু করেছে।”
বাজারে নতুন প্রবণতা
চাল ব্যবসায়ীরা জানান, মিনিকেট চালের দাম বেশি হওয়ায় এখন অনেক ভোক্তা অপেক্ষাকৃত সস্তা চালের দিকে ঝুঁকছেন। এতে করে মিনিকেট চালের চাহিদা আরও কমছে, যা ভবিষ্যতে মূল্য আরও কমাতে পারে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে—বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, আসাম ও উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে চাল আমদানি ও বাজার পরিস্থিতি
বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে ধানের বোরো মৌসুম চলছে এবং কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই কারণে সরকার আমদানি নির্ভরতা কমাতে চাইছে এবং স্থানীয় কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে।
তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বোরোর ফলন বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত আমদানি বন্ধ রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। দেশে হঠাৎ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পরিবহন সংকট দেখা দিলে চালের ঘাটতি এবং মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা থেকেই যায়।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও করণীয়
বর্তমানে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ বাজারের ওপর নির্ভরতা কমাতে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও নেপালের মতো বিকল্প বাজার খুঁজছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার বাম্পার ফলনের ওপর নির্ভর করে স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চাল আমদানির নীতিতে হঠাৎ পরিবর্তন আনার আগে স্থানীয় ফলন, মজুত, সরবরাহ চেইন ও প্রান্তিক কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। বাজার স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে সরকারি নিয়ন্ত্রিত আমদানির সুযোগ রাখা উচিত।