বিশ্ব

মার্কিন কংগ্রেসম্যানসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চীনের পাল্টা নিষেধাজ্ঞা

হংকংয়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় নিরাপত্তা আইন নিয়ে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে নতুন করে কূটনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি—চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। সর্বশেষ ঘটনায়, হংকং ইস্যুতে ‘জঘন্য আচরণ’ করার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান, সরকারি কর্মকর্তা ও কিছু বেসরকারি সংস্থার প্রধানদের বিরুদ্ধে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে চীন।

সোমবার বিকেলে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন এক বিবৃতিতে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যেভাবে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে, তা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। তারা চীনের মূল ভূখণ্ড ও হংকংয়ের ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এরই জবাবে চীন পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দিতে বাধ্য হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানাই। যদি তারা ভবিষ্যতেও হংকং সংক্রান্ত বিষয়ে ভুল পদক্ষেপ চালিয়ে যায়, চীন আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাবে।”

পাল্টা নিষেধাজ্ঞার পেছনের প্রেক্ষাপট

বিষয়টির পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৩১ মার্চ ঘোষিত এক নিষেধাজ্ঞা। ওই দিন ওয়াশিংটন চীনের জাতীয় নিরাপত্তা ও উচ্চপর্যায়ের ছয় সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল, এই কর্মকর্তারা হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে তাঁদের হয়রানি ও দমন করার চেষ্টা করেছেন।

জাতীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় ২০২৩ সালে হংকং সরকার ১৯ জন বিরোধী রাজনীতিক ও অ্যাকটিভিস্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এই আইনটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। অভিযোগ রয়েছে, এই আইন হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন ও বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করছে।

ওই ১৯ জনের মধ্যে অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, কেউ কেউ ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। হংকং পুলিশ পালিয়ে যাওয়া এই ব্যক্তিদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতি ব্যক্তির ওপর ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে।

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ

যুক্তরাষ্ট্রের মতে, চীনের প্রণীত নতুন নিরাপত্তা আইন ‘এক দেশ, দুই নীতি’ নীতির পরিপন্থী। এটি হংকংয়ের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীদের কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, “এই আইনের অপব্যবহার করে চীন গণতান্ত্রিক নেতাদের হয়রানি করছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির লঙ্ঘন।”

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা হংকংয়ের নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হংকং শাখার উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং মূল ভূখণ্ড চীনের নিরাপত্তা বিভাগে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা।

চীনের পাল্টা পদক্ষেপ

চীনের পাল্টা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান, সিনেট কমিটির সদস্য এবং কিছু বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রধান। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই ব্যক্তিদের চীনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির আর্থিক সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

যদিও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করেনি, তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই তালিকায় রয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসের হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির কয়েকজন সদস্য এবং কিছু বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে ঘটনাপ্রবাহ

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও জটিল আকার ধারণ করছে। হংকং নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা চলমান। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনায় সেই উত্তেজনার মাত্রা আরও বেড়েছে।

চীনা বিশ্ববিদ্যালয় হংকং-এর রাজনৈতিক বিশ্লেষক লি মেং হুয়া বলেন, “হংকং ইস্যু এখন আর কেবল স্থানীয় রাজনৈতিক বিতর্ক নয়, এটি আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও চীনের প্রতিক্রিয়া এর জ্বলন্ত প্রমাণ।”

তিনি আরও বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞা শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উত্তপ্ত করছে না, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার সংঘর্ষের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।”

বাণিজ্যিক সম্পর্কেও বিরূপ প্রভাব

এই কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই বাণিজ্যিক বিরোধও সামনে এসেছে। ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। চীন থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে শুরুতে ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে ওয়াশিংটন, পরে তা বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়া হয়। জবাবে চীনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপ করে।

বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। দু’দেশের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনা নিয়ে এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাঁরা চীনকে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে এবং একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকেও সংযত ভূমিকা পালনের পরামর্শ দিয়েছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “হংকংয়ে মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সব পক্ষের দায়িত্বশীল আচরণ কাম্য। নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।”

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই চলমান বিরোধ আগামী দিনে আরও বিস্তৃত রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে যে সংঘাত বাড়ছে, তা শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেই নয়, বরং গোটা বিশ্ব রাজনীতিতেই প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষ করে ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন সামনে রেখে ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া অবস্থান এবং চীনের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কৌশলগত মানসিকতা বিশ্ব পরিমণ্ডলে এক নতুন সমীকরণের জন্ম দিতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button