বানিজ্য

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রিতে রাখার নির্দেশ

বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে দেশের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) সর্বনিম্ন ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে চালানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২১ এপ্রিল জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা দেশের সব ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

এই নির্দেশনার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত সরকারের আগের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এর আগেই ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি পরিপত্র জারি করে দেশের সব অফিস, আদালত এবং প্রতিষ্ঠানকে এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার ওপরে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।

সরকারের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের উদ্যোগ

সরকারের পক্ষ থেকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিপত্রে বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, গ্রীষ্মকাল এবং সেচ মৌসুমে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। এই সময়টিতে বিদ্যুতের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যার কারণে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের দিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

পরিপত্রে আরো বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ গৃহস্থালি—সব ক্ষেত্রেই এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খরচ কমবে এবং দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ

বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শুরুতে গত ১৩ এপ্রিল দেশের সব ব্যাংককে এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে ২১ এপ্রিল এই সিদ্ধান্ত সম্প্রসারিত করে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেমন লিজিং কোম্পানি, মাইক্রোফিন্যান্স প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও এই নির্দেশনার আওতায় আনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, “এটি শুধু সরকারের নির্দেশনা মানার ব্যাপার নয়, এটি আমাদের একটি জাতীয় দায়িত্ব। সামনের গ্রীষ্মকাল ও সেচ মৌসুমে যেন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত না হয়, সে জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।”

কেন ২৫ ডিগ্রি?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রিতে রাখলে সেটি শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার সঙ্গে মানানসই থাকে, ফলে অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়া বা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচের প্রয়োজন হয় না। সাধারণত এসির তাপমাত্রা ২০-২২ ডিগ্রিতে রাখলে কম্প্রেসরকে বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়, যা বিদ্যুৎ খরচ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, ২৫ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা নির্ধারণ করলে এসির কার্যক্ষমতা বজায় থাকে এবং খরচও তুলনামূলকভাবে কম হয়।

পরিবেশবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রিতে স্থির রাখলে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের হারও কিছুটা কমানো সম্ভব। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জ্বালানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

নির্দেশনা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

যদিও সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই উদ্যোগকে ইতিবাচক বলছে, তবু অনেক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক অফিসেই এখনো ম্যানুয়ালি এসি পরিচালনা করা হয়, যার ফলে তাপমাত্রা নির্ধারণে সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না। আবার অনেক অফিসে পুরনো এসি ব্যবহার করা হয় যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর হতে পারে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এই নির্দেশনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তত্ত্বাবধায়ক দল থাকবে যারা এসির ব্যবহার ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে।

পরিবেশ রক্ষা ও জ্বালানি দক্ষতা

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জ্বালানি ব্যবস্থাপনা এখন একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার উপর চাপ কমাতে এবং কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এমন সিদ্ধান্তগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে যদি এই নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় এবং শুধু অফিস বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই নয়, বরং বাসাবাড়িতেও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়, তাহলে জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ। দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা সামাল দিতে এবং পরিবেশ রক্ষায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তবে এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতা ও তদারকির দক্ষতার উপর।

বাংলাদেশ এখন একটি বিদ্যুৎনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রতিটি ইউনিট বিদ্যুৎ সাশ্রয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তাই সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এই নির্দেশনা গুরুত্ব সহকারে বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button