দেশে ১৫ মাসে নতুন ১২৮ তৈরি পোশাক কারখানা: নতুন কর্মসংস্থান এবং চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ, গত বছর এবং চলতি বছরে নানা চ্যালেঞ্জ ও উন্নতির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিশ্ববাজারে রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে নতুন তৈরি পোশাক কারখানার স্থাপন ও কিছু পুরোনো কারখানার বন্ধের ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। তবে, এই উত্থান-পতনের মধ্যে নতুন করে ১২৮টি কারখানা যোগ হওয়া এবং কিছু বড় কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো দেশের শ্রমবাজার ও রপ্তানি খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
নতুন ১২৮টি তৈরি পোশাক কারখানা এবং ৭৪,০০০ নতুন কর্মসংস্থান
গত ১৫ মাসে (জানুয়ারি ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫) বিজিএমইএর (বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) সদস্যপদ গ্রহণকারী ১২৮টি নতুন তৈরি পোশাক কারখানা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারখানাগুলোর পূর্ণ উৎপাদন চালু হলে প্রায় ৭৪,০০০ নতুন মানুষের কর্মসংস্থান হবে, যা দেশের কর্মসংস্থান খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
নতুন এই কারখানাগুলোর বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যার মধ্যে ১৮টি কারখানায় ১,০০০ জনেরও বেশি শ্রমিক কাজ করবেন। এসব নতুন কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল একেএইচ আউটওয়্যার, এ জেড কম্পোজিট, নেক্সটন, এলএসএ অ্যাপারেলস, সিটেক ফ্যাশন, সুপ্রিম আউটফিট, স্প্যারো গ্রিনটেক ইত্যাদি।
এ জেড কম্পোজিটের মতো প্রতিষ্ঠান গাজীপুরে নতুন কারখানা স্থাপন করে এবং বর্তমানে সেখানে ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। তবে, এ কারখানা পূর্ণ উৎপাদনে গেলে সেখানে ৭০০-৮০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জহিরুল হাসান জানান, তারা ঈদুল আজহার পর পুরোপুরি উৎপাদনে যাবেন।
তৈরি পোশাক রপ্তানি: উত্থান এবং চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি।
তবে, নতুন রপ্তানি অর্ডারের মাঝে কিছু অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক আরোপের পর বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও। স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শোভন ইসলাম জানান, গত শরৎ মৌসুমে ক্রয়াদেশ কমেছে এবং পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত হতে পারে।
কারখানা বন্ধ হওয়া এবং কর্মসংস্থানের ক্ষতি
যদিও নতুন কারখানা আসছে, তবে কিছু পুরোনো কারখানা বন্ধও হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ১১৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, যার ফলে ৯৬,১০৪ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন। এই বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই গত আগস্টের পর বন্ধ হয়ে গেছে, যার মধ্যে ৬৯টি কারখানা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, এবং সেখানে প্রায় ৭৬,৫০৪ কর্মী কাজ হারিয়েছেন।
বেক্সিমকো গ্রুপের ২৪টি কারখানা বন্ধ হওয়ার ঘটনা দেশের জন্য দুঃখজনক হলেও, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই অস্তিত্বহীন ছিল। বেক্সিমকো শিল্পপার্কের ১৪টি কারখানা ২৮ ফেব্রুয়ারি বন্ধ করে দেওয়া হয়, যেখানে ৩১,৬৭৯ জন শ্রমিক ও ১,৫৬৫ কর্মচারী কাজ করতেন। তবে, সরকার তাদের পাওনা পরিশোধে ৫২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা প্রদান করেছে, যদিও অনেক শ্রমিক এখনও তাদের পাওনা বুঝে পাননি।
কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ এবং ভবিষ্যৎ 전망
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল জানান, দেশের বড় ও মাঝারি পোশাক কারখানাগুলো উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, আধুনিক প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) বিনিয়োগ করছে। এ কারণে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তবে, ব্যবসার খরচ বাড়ার কারণে ছোট কারখানাগুলো টিকে থাকতে পারছে না।
এছাড়া, বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘নতুন কারখানা চালু হওয়া ও কিছু বন্ধ হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, যা নতুন বিনিয়োগে সতর্কতা তৈরি করেছে।’
আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প আগামী দিনে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। তবে, আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদে বিনিয়োগ এবং রপ্তানি বাজারের বৈচিত্র্যকরণ এ খাতের দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। এর পাশাপাশি, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী পরিবেশ কীভাবে ব্যবসার জন্য অনুকূল হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যদি আধুনিকায়ন এবং উন্নত প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে পারে, তবে তা শুধু রপ্তানি বৃদ্ধি করবে না, দেশের শ্রমবাজারেও নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। তবুও, চ্যালেঞ্জ হিসেবে রপ্তানি বাজারের অনিশ্চয়তা এবং ব্যবসার উচ্চ খরচ মোকাবেলা করা উচিত হবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যে বিপুল সংখ্যক নতুন কারখানা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য আশাব্যঞ্জক। তবে, কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে কর্মসংস্থানের ক্ষতি হলেও, নতুন প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেই শিল্পটির সাফল্য নিশ্চিত হবে।