খেলাফুটবল

পারফরমেন্স ও ফিটনেস ঠিক থাকলেই ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলবেন মেসি

ফুটবল বিশ্বে সবসময়ই যে কজন কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়, তাদের শীর্ষ সারিতেই রয়েছেন আর্জেন্টিনার জার্সি গর্বিত করা লিওনেল মেসি। কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে বহু প্রতীক্ষিত বিশ্বচ্যাম্পিয়নির স্বাদ এনে দেওয়ার পর থেকেই একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রীড়া অঙ্গনে—২০২৬ সালের বিশ্বকাপে কি দেখা যাবে মেসিকে? ফুটবলপ্রেমীদের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে নিজ মুখেই উত্তর দিলেন আর্জেন্টিনার এই সুপারস্টার।

সম্প্রতি সাবেক আর্জেন্টাইন ফুটবলার কিকে উলফের ‘সিম্পলি ফুটবল’ শো-তে অংশ নিয়ে এই বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন মেসি। বললেন, শুধু নামের জোরে নয়—শারীরিক সক্ষমতা এবং মাঠের পারফরম্যান্সই হবে তার ২০২৬ বিশ্বকাপ খেলার মূল মাপকাঠি। এই সিদ্ধান্তে তিনি নিজেকে সর্বোচ্চ সৎ রাখতে চান বলেও জানান।

মেসির ভাষায়, “অবশ্যই আমি ২০২৬ বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবছি। তবে এই বছরটা আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। যদি আমার শরীর ও ফর্ম যথাযথ থাকে, তবেই জাতীয় দলে থাকা উচিত। বিশ্বকাপ দলে আমি থাকবো কি না, সে বিষয়ে আমার নিজের প্রতি সম্পূর্ণ সৎ থাকতে হবে।”

এই বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হলো, বিশ্বকাপে নিজের উপস্থিতি নিয়ে কোনো আবেগ নয়, বরং বাস্তবতাই বড় ভূমিকা রাখবে। কারণ নিজের ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞ এই ফুটবলারের এখন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিজেকে ফিট রাখা এবং ফর্ম ধরে রাখা।

নামের ভার নয়, মাঠের পারফরম্যান্সই মুখ্য

ফুটবল বিশ্বে লিওনেল মেসির নামই একধরনের ব্র্যান্ড। তবে নিজেকে সেই নামের ভারে বেঁধে রাখতে নারাজ এই ফুটবল তারকা। দীর্ঘ ফুটবল ক্যারিয়ারে অসংখ্য শিরোপা ও ব্যক্তিগত স্বীকৃতি পেলেও, ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে পরাজয়ের যন্ত্রণা আজও পোড়ায় তাকে।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেসি বলেন, “২০১৪ বিশ্বকাপে শিরোপা জিততে না পারা আমার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। তবে পরে বিশ্বকাপ জেতার মাধ্যমে সেই কষ্ট অনেকটাই কমে গেছে। হয়তো আমি দুটি বিশ্বকাপ জিততে পারতাম, তবে দিনশেষে আমি গর্বিত যে একটা বিশ্বকাপ আমার ঝুলিতে আছে। এর বেশি কিছু চাইলে তা অন্যায় হতো। আমি কেবল বিশ্বকাপই নয়, ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সব কিছুই জিতেছি।”

ক্লাব ফুটবলে বার্সেলোনার হয়ে একের পর এক শিরোপা জয়ের মধ্যেও মেসির ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের ট্রফি দীর্ঘদিন অধরা ছিল। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জয়ের মাধ্যমে সেই অপূর্ণতা কিছুটা মেটানোর পর, ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপা জিতে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে ফেলেন মেসি।

নতুন প্রজন্মের প্রতি আশাবাদী এলএম টেন

মেসি তার উত্তরসূরিদের নিয়েও আশাবাদা প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে বার্সেলোনা ও স্পেনের হয়ে আলো ছড়ানো তরুণ ফুটবলার লামিনে ইয়ামাল সম্পর্কে বেশ উচ্ছ্বসিত এলএম টেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই স্পেন জাতীয় দলের হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়া এই তরুণের পারফরম্যান্স মুগ্ধ করেছে মেসিকে।

তিনি বলেন, “সে যা করেছে, তা সত্যিই অসাধারণ। ১৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে এমন পরিপক্বতা দেখানো দুর্লভ ঘটনা। সে নিজেকে অসাধারণভাবে তৈরি করছে। আমি নিশ্চিত, সে বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রতিভা এবং ভবিষ্যতে আরও বড় কিছু করবে।”

মেসির এমন উচ্ছ্বাসই প্রমাণ করে, নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের প্রতি তার দৃষ্টি এবং ভালোবাসা ঠিক কতটা আন্তরিক। শুধু নিজের ক্যারিয়ারেই নয়, ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত এই তারকা।

স্কালোনি ও গার্দিওলার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা

জাতীয় দল ও ক্লাবের কোচদের অবদান স্মরণ করতে গিয়ে মেসি আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ লিওনেল স্কালোনি এবং তার প্রিয় ক্লাব কোচ পেপ গার্দিওলার কথা।

মেসির কণ্ঠে স্কালোনির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্পষ্ট ছিল, “স্কালোনি একজন অসাধারণ মানুষ এবং কোচ। তার অধীনে দল শুধু শিরোপা জেতেনি, বরং নতুন এক ঐক্য ও দলীয় সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।”

অন্যদিকে, গার্দিওলার প্রশংসা করতে গিয়ে আরও বড় প্রশংসাসূচক বিশেষণ ব্যবহার করেছেন মেসি। বললেন, “পেপ গার্দিওলা সত্যিই অন্য গ্রহের কোচ। তার চিন্তাভাবনা, কৌশল এবং খেলার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ। সে যা করেছে, তা আর কেউ করে দেখাতে পারেনি। তার ফুটবল ধারণা ও কোচিং স্টাইলের কারণে আজকের আধুনিক ফুটবল এত উন্নত হয়েছে।”

বিশ্বকাপ নিয়ে না থাকা মরিয়া ভাব

লিওনেল মেসির এই সাক্ষাৎকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার ভেতরের নির্লিপ্ততা। ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সেটি নিয়ে তার মধ্যে তেমন কোনো মরিয়া ভাব লক্ষ্য করা যায়নি। বরং ফুটবল ক্যারিয়ারে অর্জিত সব কিছুতেই তিনি পরিতৃপ্ত এবং শান্ত।

বিশ্ব ফুটবলে দীর্ঘ সময় একাধিপত্য কায়েম করে রাখার পর, নিজেকে সৎ ও বাস্তববাদী হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন তিনি। এমনকি ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার পর কী করবেন, সেই বিষয়েও এখনও কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন। বর্তমান উপভোগ করাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ কথা

লিওনেল মেসির এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে ফুটবল বিশ্বে আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ করবে। মেসির মতো খেলোয়াড়ের পেশাদারিত্ব, ফিটনেস এবং সৎ মানসিকতা কেবল ফুটবলপ্রেমীদেরই নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খেলোয়াড়দের জন্যও অনুপ্রেরণার বাতিঘর। ২০২৬ বিশ্বকাপে মেসিকে দেখা যাবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ফুটবল বিশ্ব তার জন্য অপেক্ষায় থাকবেই।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button