ইসরায়েলি আগ্রাসন, গাজায় নিহত ৫১ হাজার ছাড়াল

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ এক বিভীষিকাময় মানবিক সংকটে রূপ নিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ১৮ মাসব্যাপী চলমান আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৫১ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। প্রতিদিনই নতুন করে বোমা হামলা ও বিমান হামলার শিকার হচ্ছে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা হাজারো মরদেহ এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
২৪ ঘণ্টায় ১৭ জন নিহত, আহত ৬৯
মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল ২০২৫) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় আরও ১৭ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬৯ জন। এর আগে ১৮ মার্চ ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করে পুনরায় গাজায় অভিযান শুরু করে। এরপর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৩০ জন নিহত এবং ৪ হাজার ৩০২ জন আহত হয়েছেন।
গাজার কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ইসরায়েলের দফায় দফায় চালানো বিমান ও স্থল অভিযানে বহু ভবন এবং ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপে এখনও প্রায় ১০ হাজার মরদেহ আটকে আছে। উদ্ধারকাজ চালানো যাচ্ছে না, কারণ একদিকে রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, অন্যদিকে অ্যাম্বুলেন্স ও উদ্ধার সরঞ্জাম পর্যাপ্ত নেই। অব্যাহত বোমা হামলার মধ্যেও সাহসিকতার সঙ্গে উদ্ধারকারীরা কাজ করে চলেছেন, তবে তা যথেষ্ট নয়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া আগ্রাসনের ভয়াবহতা
ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের এক আক্রমণের জবাবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ভয়াবহ হামলা শুরু করে ইসরায়েল। প্রথমে বিমান হামলা এবং পরে স্থল অভিযান শুরু হয়। টানা আঠারো মাসের এই যুদ্ধের ফলে গাজার হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, পানির সরবরাহ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, বাজার ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ প্রায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে।
বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার পরিমাণ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বারবার গাজার পরিস্থিতিকে “মানবিক বিপর্যয়” হিসেবে উল্লেখ করে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানালেও তা উপেক্ষা করে যাচ্ছে ইসরায়েলি প্রশাসন।
ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব: ১১ জিম্মির বিনিময়ে ৪৫ দিনের বিরতি
তবে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ এবং মধ্যস্থতাকারী রাষ্ট্রগুলোর প্রচেষ্টায় কিছুটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল একটি নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় ৪৫ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতি পালন করা হবে, যার বিনিময়ে হামাসকে ১১ জন ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি দিতে হবে।
হামাস এই প্রস্তাব যাচাই করে দেখছে বলে জানিয়েছে। সংগঠনটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করছে এবং দ্রুতই নিজেদের অবস্থান জানাবে।
হামাসের অবস্থান: স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহার অপরিহার্য
হামাস স্পষ্ট করে জানিয়েছে, তারা কেবলমাত্র সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে নয়, স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধে আগ্রহী। তাদের প্রধান দাবি হচ্ছে—
- গাজা থেকে ইসরায়েলের সেনা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার
- সামরিক অভিযান চিরতরে বন্ধ করা
- মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা
- অবরোধ প্রত্যাহার
হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সামি আবু জুহরি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ইসরায়েল যদি সত্যিই যুদ্ধ বন্ধে আগ্রহী হয়, তাহলে শত্রুতা বন্ধ করতে হবে এবং সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। নিছক সাময়িক বিরতি দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ধোঁকা দেওয়া যাবে না।”
নতুন প্রস্তাবে ‘নিরস্ত্রীকরণ’-এর ইঙ্গিত
এবারের প্রস্তাবে একটি নতুন উপাদান সংযুক্ত হয়েছে। ইসরায়েল প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপে হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ (disarmament) নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তাব দিয়েছে। বিষয়টি হামাস কীভাবে নেবে, সেটি নিয়ে পর্যবেক্ষকরা সতর্ক। কারণ, হামাস সবসময় নিজেদের “মুক্তির লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া প্রতিরোধ আন্দোলন” হিসেবে উপস্থাপন করে, আর নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মানবিক বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইতোমধ্যে জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও চিকিৎসাসেবার অভাবে হাজার হাজার শিশু ও বৃদ্ধ প্রাণ হারাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়েছে। পাঁচটি প্রধান হাসপাতালের মধ্যে কেবল একটি আংশিকভাবে কাজ করছে। মেডিসিন, অক্সিজেন, জ্বালানি—সবকিছুর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ইসরায়েলের সামরিক কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তবে ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এখনও পূর্ণ সামরিক সহায়তা বন্ধ করেনি, যদিও বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন রাজনীতিতেও এ নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে।
শান্তি আসবে কবে?
গাজা উপত্যকা এখন এক খোলা কবরস্থানে পরিণত হয়েছে—বাঁচা-মরার লড়াই চলছে প্রতিটি মুহূর্তে। যুদ্ধে শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। হামাস ও ইসরায়েল উভয়ের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে, কিন্তু স্থায়ী শান্তির রূপরেখা এখনও অনিশ্চিত।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হচ্ছে, এ ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের সমাপ্তি টানতে রাজনৈতিক চাপ ও কূটনৈতিক উদ্যোগকে আরও জোরদার করা। শুধুমাত্র সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে নয়, বরং একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস বইতে পারে।