বিশ্ব

রাশিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের ২১ জন নিহত, আহত ৮৩

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার চলমান যুদ্ধে আবারও ভয়াবহ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এবার রাশিয়ার ছোড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলের ‘সুমি’ শহরের কেন্দ্রস্থলে আঘাত হানে। স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৯টার দিকে চালানো এই হামলায় এখন পর্যন্ত ২১ জন নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইহোর ক্লাইমেনকো

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও বহু মানুষ আটকে রয়েছে, ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

ভয়াবহতা ছিল নজিরবিহীন: প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে একে চলতি বছরের অন্যতম ‘নৃশংস ও মারাত্মক’ হামলা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক এলাকাকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের হামলা যুদ্ধাপরাধের শামিল।”

জেলেনস্কি আরও বলেন, “আমরা মস্কোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখতে চাই। আমাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক শক্তিকে একজোট হতে হবে।”

হামলার পেছনে কূটনৈতিক সময়সূচি?

ইউক্রেনের ‘সেন্টার ফর কাউন্টারিং ডিসইনফর্মেশন’-এর পরিচালক আন্দ্রি কোভালেঙ্কো জানান, এই হামলা মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিভ উইটকফের সাম্প্রতিক মস্কো সফরের ঠিক পরেই চালানো হয়। তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি এই সফর এবং হামলার মধ্যে সময়গত সম্পর্ক কাকতালীয় নয়। এটি রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হতে পারে।”

সুমি শহরের ধ্বংসচিত্র

উত্তর ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী শহর সুমি রাশিয়ার আগ্রাসনের শুরুর দিক থেকেই বারবার হামলার শিকার হয়ে আসছে। এবার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সুমি শহরের জনবহুল বাণিজ্যিক এলাকা ও আবাসিক ভবনের ওপর আঘাত হানে। শহরের প্রশাসনিক ভবন, স্কুল, মার্কেট এবং একটি শিশু হাসপাতাল এই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।

ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে আহত ও নিহতদের উদ্ধার করতে রাতভর অভিযান চালিয়েছে জরুরি উদ্ধারকারী দল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দগ্ধ ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে উদ্ধারকর্মীরা বাঁচার আকুতি শুনে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।

মার্কিন প্রতিক্রিয়া

ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না আসলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটি অপ্রকাশিত সূত্র জানিয়েছে, তারা এই হামলার তথ্য যাচাই করছে এবং এর পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত মূল্যায়ন করা হবে।

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বারবার পশ্চিমা অস্ত্র সহায়তা এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির দাবি জানানো হলেও এই হামলা প্রমাণ করে, ইউক্রেন এখনও পূর্ণমাত্রার রুশ হামলা প্রতিরোধে সক্ষম নয়।

কিয়েভে ড্রোন হামলাও চালিয়েছে মস্কো

সুমি হামলার আগের দিন শনিবার, ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভেও ড্রোন হামলা চালায় রাশিয়া। কিয়েভের তিনটি বড় গুদামঘরে আগুন ধরে যায়। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জানায়, রাশিয়া মোট ৮৮টি ড্রোন ছুঁড়েছিল, যার মধ্যে ৫৬টি তারা ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে

এই ড্রোনগুলো বেশিরভাগই ছিল ইরানি উৎপাদিত শাহেদ ড্রোন, যা কম উচ্চতায় চলাচল করে এবং সহজে রাডারে ধরা পড়ে না। কিয়েভের সামরিক মুখপাত্র বলছেন, এই হামলা মূলত অবকাঠামোগত ধ্বংস সাধন ও জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য চালানো হয়েছে।

যুদ্ধের নতুন ধাপ?

বিশ্লেষকদের মতে, সুমি ও কিয়েভে একযোগে চালানো হামলা রাশিয়ার কৌশলে নতুন রূপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাশিয়া ধীরে ধীরে ব্যালিস্টিক মিসাইল ও ড্রোন হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের ধারণা, রাশিয়া এখন ইউক্রেনের সেনা অবস্থান নয়, বরং বেসামরিক পরিকাঠামো ধ্বংসের মাধ্যমে যুদ্ধের ভারসাম্য পাল্টাতে চাইছে।

মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ

হিউম্যান রাইটস ওয়াচঅ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সুমি শহরের উপর এই হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। তারা স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে এবং রাশিয়াকে মানবিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার আহ্বান জানিয়েছে।

ইউক্রেনের পাল্টা প্রতিক্রিয়া

জবাবে ইউক্রেন পূর্ব ফ্রন্টে রুশ অবস্থানে পাল্টা হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে কিয়েভ। তবে কোন এলাকায় কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বছরে গড়ালেও শান্তির কোনো লক্ষণ নেই। বরং প্রতিদিনের হামলায় বেড়েই চলেছে প্রাণহানি, ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানবিক বিপর্যয়। সুমি শহরে রাশিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এক কঠিন প্রশ্ন রেখে গেল: এখনও কি নীরব থাকা সম্ভব?

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button