ডিসেম্বরে নয়, ২০২৬ জুনে নির্বাচন হতে পারে

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম আরও দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তবে, নির্বাচন নিয়ে তাঁর দেওয়া সময়সীমা সংশোধন করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। প্রাথমিক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরেই নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পরে সংশোধিত বিবৃতিতে জানানো হয়—নির্বাচন হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে, সময়সীমা আরও বিস্তৃত রাখা হয়েছে।
বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় যমুনায়, অংশ নেয় কমিশনের শীর্ষ সদস্যরা
শনিবার (১২ এপ্রিল) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এই নির্বাচন সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা দেন মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার।
বৈঠকে আলী রীয়াজ ও বদিউল আলম মজুমদার কমিশনের কার্যক্রমের অগ্রগতি তুলে ধরেন এবং জানান, নির্বাচনপূর্ব সংস্কার ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত মোট আটটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথক আলোচনা চলছে
কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করা হচ্ছে এবং তারা বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ পর্যালোচনা করছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক মতৈক্য ও আস্থার পরিবেশ তৈরি করাই মূল লক্ষ্য।
এছাড়া জনমত যাচাই এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিও গৃহীত হয়েছে। এতে সম্মিলিতভাবে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে বলে জানান কমিশন সংশ্লিষ্টরা।
নির্বাচন সময়সূচি নিয়ে বিবৃতি সংশোধন
প্রথম দফায় প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, “আগামী ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য নিয়ে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।”
তবে সংবাদটি গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর বিকেলের দিকে প্রেস উইং দ্বিতীয় বিবৃতি পাঠিয়ে ওই সময়সীমা সংশোধন করে জানায়, “আগামী ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এই সময়সীমার মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংশোধন সম্ভবত নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনার সময়সীমা আরও নমনীয় ও বাস্তবভিত্তিক করার লক্ষ্যে করা হয়েছে। একাধিক রাজনৈতিক দল এখনও সংলাপে অংশ নেয়নি, আবার কেউ কেউ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বরের নির্দিষ্ট সময়সীমা চাপ তৈরি করতে পারত।
মুহাম্মদ ইউনূসের বার্তা: গণতান্ত্রিক উত্তরণের সুযোগ
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডসম্পন্ন নির্বাচন অত্যাবশ্যক। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা।”
তিনি আরও বলেন, “এই নির্বাচন হবে দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটি মোড় ঘোড়ার মুহূর্ত, যেখানে আমরা সংঘাত নয়, সমঝোতার মাধ্যমে পথ নির্ধারণ করব।”
আগামী কর্মপরিকল্পনা: বিএনপির সঙ্গে আলোচনা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী বড় কর্মসূচি হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সঙ্গে আলোচনা। কমিশনের সদস্যদের মতে, বিএনপি এই মুহূর্তে অন্যতম প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় তাদের মতামত ও অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনী সংস্কারের প্রক্রিয়া পূর্ণতা পাবে না।
বৈঠকের সময় কমিশনের সদস্যরা জানান, “আমরা প্রত্যেকটি দলের কথা মনোযোগ সহকারে শুনছি এবং তাদের দাবি, আপত্তি ও প্রস্তাব বিবেচনায় নিচ্ছি। আশা করি, বিএনপির সঙ্গেও ইতিবাচক আলোচনা হবে।”
বিশ্লেষণ: সময় বাড়ানোর কৌশল না কি বাস্তবতা?
নির্বাচনের সময়সীমা ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করাকে কেউ কেউ রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নেওয়ার কৌশল হিসেবে দেখছেন। কারণ, একদিকে যেমন সব দলকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে, অন্যদিকে নির্বাচন প্রস্তুতির জন্য প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক কাঠামো প্রস্তুত করাও সময়সাপেক্ষ।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “যদি এই সময়সীমা রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় এবং দলগুলোকে আস্থায় আনা সম্ভব হয়, তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা অনেক গুণ বেড়ে যাবে।”
দেশের জনগণের প্রত্যাশা: স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন
জনগণের পক্ষ থেকেও এখন সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা একটি নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন। বিগত নির্বাচনগুলোতে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ না থাকায় ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।