আবারও স্বর্ণের দামে রেকর্ড, ভরি ছাড়াল ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা

দেশের স্বর্ণবাজারে আবারও নতুন ইতিহাস রচনা হয়েছে। সবচেয়ে ভালো মানের ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বেড়ে প্রতি ভরিতে ১ লাখ ৬৩ হাজার ২১৪ টাকায় পৌঁছেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মূল্য। এর আগে সর্বোচ্চ ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭ টাকা।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) শনিবার (১২ এপ্রিল) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। নতুন এই মূল্য ১৩ এপ্রিল, রবিবার থেকে সারা দেশে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।
কতটুকু বাড়ল স্বর্ণের দাম?
গত ১১ এপ্রিল যে দাম নির্ধারণ ছিল, তার তুলনায় এবার দাম বেড়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। নিচে ক্যারেটভিত্তিক দামবৃদ্ধি ও নতুন দাম তুলে ধরা হলো:
ক্যারেট | আগের দাম (ভরি প্রতি) | বৃদ্ধি (টাকা) | নতুন দাম (ভরি প্রতি) |
---|---|---|---|
২২ ক্যারেট | ১,৫৯,০২৭ টাকা | ৪,১৮৭ টাকা | ১,৬৩,২১৪ টাকা |
২১ ক্যারেট | ১,৫১,৭৯৫ টাকা | ৪,০০১ টাকা | ১,৫৫,৭৯৬ টাকা |
১৮ ক্যারেট | ১,৩০,১১২ টাকা | ৩,৪২৯ টাকা | ১,৩৩,৫৪১ টাকা |
সনাতন | ১,০৭,৩৪৪ টাকা | ২,৯২৭ টাকা | ১,১০,২৭১ টাকা |
বাজুস বলছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবী স্বর্ণের (পরিশোধিত স্বর্ণ) দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে এই দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি চলতি বছরে স্বর্ণের দামে পঞ্চম দফা বৃদ্ধি।
রুপার দাম অপরিবর্তিত
স্বর্ণের দামে বড় পরিবর্তন এলেও রুপার দামে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বিভিন্ন ক্যারেট অনুযায়ী রুপার দাম নিচে দেওয়া হলো:
- ২২ ক্যারেট: ২,৫৭৮ টাকা
- ২১ ক্যারেট: ২,৪৪৯ টাকা
- ১৮ ক্যারেট: ২,১১১ টাকা
- সনাতন পদ্ধতি: ১,৫৮৬ টাকা
স্বর্ণের দাম বাড়ার কারণ কী?
বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রার মান হ্রাস, এবং স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধিই মূলত দাম বাড়ার কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে আউন্সপ্রতি স্বর্ণের দাম ২,৩০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা একটি সর্বকালীন উচ্চ পর্যায়।
বাংলাদেশে আবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়াও মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। কারণ, দেশের স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে ডলার নির্ভরতা রয়েছে। তদুপরি, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাতের ফলে স্বর্ণে বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক বাড়ছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে দামে।
বাজুস কী বলছে?
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “আমরা আন্তর্জাতিক বাজার, স্থানীয় চাহিদা এবং জুয়েলারি ব্যবসার সামগ্রিক দিক বিবেচনা করেই মূল্য নির্ধারণ করি। বর্তমানে তেজাবী স্বর্ণের আমদানি ব্যয় বেড়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দামও ঊর্ধ্বমুখী।”
বাজুস আরও জানায়, দেশের জুয়েলারি খাতের ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং গ্রাহকরা যেন স্বচ্ছভাবে বাজার পরিস্থিতি জানতে পারেন, সে লক্ষ্যেই দফায় দফায় মূল্য সংশোধন করা হচ্ছে।
স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বাড়লেও ক্রেতা কমে যায়নি, বরং কিছুটা ‘প্যানিক বায়িং’ দেখা যাচ্ছে। অনেকেই ধারণা করছেন সামনে আরও দাম বাড়তে পারে, তাই এখনই কিনছেন।
চট্টগ্রামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, “বিয়ে মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। অনেকে আগেভাগে স্বর্ণ কিনে নিচ্ছেন। দাম যতই বাড়ুক, চাহিদা কমছে না।”
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
স্বর্ণের এই দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য একটি চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যারা বিয়ে বা উপহারের জন্য স্বর্ণ কিনে থাকেন, তাঁদের জন্য এটি উদ্বেগের।
একজন ক্রেতা বলেন, “বিয়ের জন্য কিছু গহনা কেনার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাজেটের অনেকটাই কেটে ফেলতে হবে বা নকল গহনায় যেতে হবে।”
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বর্ণ শুধু অলঙ্কার নয়, নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবেও কাজ করে। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মুদ্রাস্ফীতি, এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উত্তেজনা—সব মিলিয়ে স্বর্ণ এখন ‘সেইফ হ্যাভেন’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. শামীম আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম শুধু আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং স্থানীয় আমদানি ব্যয়, ভ্যাট-শুল্ক ও ডলার সংকটের কারণেও প্রভাবিত হয়। এসব ফ্যাক্টর ঠিক না হলে দাম আরও বাড়তে পারে।”
ভবিষ্যতে কী হতে পারে?
বর্তমানে বৈশ্বিক স্বর্ণবাজারে আরও দাম বৃদ্ধির আভাস রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত, চীনের বাজারে মন্দা, এবং মার্কিন সুদের হারের অনিশ্চয়তা স্বর্ণের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশে রমজান ও ঈদ মৌসুমে চাহিদা বাড়ার ফলে আসন্ন মাসগুলোতেও স্বর্ণের দাম স্থিতিশীল না থেকে বাড়তির দিকে থাকার আশঙ্কা রয়েছে।