ইপিএলে ১২৬ দেশের প্রতিনিধিত্ব, বাংলাদেশের নাম লিখিয়েছেন হামজা চৌধুরী

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ (ইপিএল)—যেটি শুধু ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্তরের পেশাদার ফুটবল লিগই নয়, বরং বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল প্রতিযোগিতাও—সেখানে প্রতিনিধিত্ব করেছে ১২৬টি দেশের ফুটবলার। এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশও, একজন ফুটবলারের মাধ্যমে।
বৈচিত্র্য ও গর্বের মিশেল: ইপিএলের বিশ্বজনীনতা
সম্প্রতি প্রিমিয়ার লিগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট প্রকাশ করা হয়। এতে প্রতিটি দেশের সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ফুটবলারের নাম এবং সেই দেশ থেকে প্রিমিয়ার লিগে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা তুলে ধরা হয়। এটি ছিল একধরনের বৈচিত্র্যের উদ্যাপন।
এই তালিকায় বাংলাদেশের নামের পাশে রয়েছে হামজা চৌধুরী। কারণ, এখন পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগে কেবল এই একজনই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
হামজা চৌধুরী: ব্রিটিশ-বাংলাদেশি গর্ব
হামজা দেওয়ান চৌধুরী, পুরো নাম। জন্মেছেন ইংল্যান্ডেই, তবে তাঁর মাতৃপক্ষের শেকড় বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। তাঁর মা একজন বাংলাদেশি, আর বাবা গ্রানাডিয়ান। হামজার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি ও ক্যারিবীয় রক্তের মিশেল পাওয়া এক অনন্য ফুটবলার।
২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয় তাঁর, ইংলিশ ক্লাব লেস্টার সিটির হয়ে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি ৫৭টি প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচ খেলেছেন।
মডার্ন মিডফিল্ডার: পজিশন, খেলা ও শক্তি
হামজার খেলার ধরন মূলত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। মাঠে তিনি একজন ট্যাকল মাস্টার হিসেবে পরিচিত। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ভেঙে দিয়ে বল পুনরুদ্ধার এবং সঠিক সময়ে বল বিলি করা—এটাই তাঁর কাজ।
তাঁর খেলার বিশেষ দিক:
- ধৈর্য ও পজিশন সেন্স
- ট্যাকল ও ইন্টারসেপশনে পারদর্শিতা
- শরীরিক শক্তি ও বল দখলের ক্ষমতা
- দলের জন্য নিরলস পরিশ্রম
তিনি এমন একজন খেলোয়াড়, যাকে কোচরা মাঠে রাখলে নিশ্চিন্ত থাকেন—কারণ তার পজিশনিং ও দৃঢ়তা পুরো দলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
লেস্টারে শুরু, শেফিল্ডে ধার
বর্তমানে তিনি শেফিল্ড ওয়েন্সডে’র হয়ে ধারে খেলছেন, তবে তাঁর মালিকানা এখনো লেস্টার সিটির হাতেই। ২০২৫ সালের জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডোতে তিনি শেফিল্ডে যান—খেলার সময় ও অভিজ্ঞতা বাড়ানোর লক্ষ্যে।
তবে তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে লেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকার সম্ভাবনার ওপর।
অবনমনের শঙ্কা: লেস্টার কি পারবে বাঁচতে?
২০২৪-২৫ মৌসুমের ইপিএল টেবিলে লেস্টার সিটি রয়েছে ১৯ নম্বরে। এখন পর্যন্ত তারা ৩১ ম্যাচে মাত্র ১৭ পয়েন্ট অর্জন করেছে। এই পারফরম্যান্সে অবনমনের শঙ্কা প্রবল।
তিনটি দল প্রতি মৌসুমে অবনমিত হয়, এবং বর্তমানে লেস্টার সেই তলানিতে থাকা তিন দলের একটি। যদি তারা অবনমিত হয়, তাহলে আগামী মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে দেখা যাবে না হামজাকে, যতক্ষণ না তিনি অন্য কোনো প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবে যোগ দেন।
হামজার চোখে বাংলাদেশ
হামজা একাধিকবার গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে তার গর্ব প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন,
“আমি আমার শিকড় নিয়ে গর্বিত। আমার মা বাংলাদেশি, এবং আমি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভাষা ও খাবার ভালোবাসি।”
তাঁর এই মন্তব্য শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদেরই গর্বিত করেনি, বরং দেশের ভেতরেও তৈরি করেছে একধরনের আত্মবিশ্বাস—যে বাংলাদেশের নাম প্রিমিয়ার লিগের মতো মঞ্চেও উঠতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ার সাড়া
প্রিমিয়ার লিগের পোস্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। হাজার হাজার মানুষ হামজার নাম দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে:
- তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন
- বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন
- ভবিষ্যতে জাতীয় দলের হয়ে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন
অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন—হামজা কি বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন? যদিও তিনি এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের যুব দলে খেলেছেন, তবে এখনো বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে খেলার পথ উন্মুক্ত রয়েছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: জাতীয় দল ও অনুপ্রেরণা
হামজার উপস্থিতি বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য এক অনুপ্রেরণা হতে পারে। প্রিমিয়ার লিগে খেলা এমন একজন ফুটবলার যদি বাংলাদেশি জাতীয় দলে খেলেন, তাহলে:
- দল পাবে একজন আন্তর্জাতিক মানের মিডফিল্ডার
- তরুণ ফুটবলারদের জন্য তিনি হবেন রোল মডেল
- বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের ফুটবলের পরিচিতি বাড়বে বহুগুণে
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) যদি কৌশলে তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে, তাহলে এটি হতে পারে ইতিহাস গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ।
বৈচিত্র্যেই শক্তি, আর হামজাই তার প্রতিচ্ছবি
ইপিএল শুধু একটি ফুটবল লিগ নয়, এটি বিশ্বফুটবলের প্রতিচ্ছবি। সেখানে ১২৬টি দেশের প্রতিনিধিত্ব মানে, ফুটবল সত্যিই সবার খেলা। এবং বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেখানে ফুটবল অবকাঠামো এখনো উন্নয়নশীল, সেই দেশও একবার হলেও তার প্রতিনিধিত্ব করেছে—এই গর্ব আমাদের সবার।
হামজা চৌধুরী এখনো যুবক, তার ক্যারিয়ার অনেকদূর যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। হয়তো একদিন, তিনি শুধু প্রিমিয়ার লিগেই নন, বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলেও ইতিহাস লিখবেন।