পানামা গিয়ে ‘খাল দখলের হুমকি’ দিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের সাম্প্রতিক পানামা সফর বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পানামা খাল নিয়ে তার কঠোর ভাষার বক্তব্যকে অনেকেই ওয়াশিংটনের একরকম ‘ভৌগোলিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকেত’ হিসেবে দেখছেন। হেগসেথ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে আমেরিকা এখন পানামা খালের ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ নিতে প্রস্তুত।
৮ এপ্রিল পানামা নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটি থেকে দেওয়া তার বক্তব্যে হেগসেথ বলেন, “এই জলপথ শুধু আমাদের বাণিজ্যের জন্য নয়, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমরা নিশ্চিত করতে চাই, আমেরিকার জাহাজ ও স্বার্থ যেন হুমকির মুখে না পড়ে।” তিনি বলেন, প্রতি বছর প্রায় ১০০টি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এই খাল ব্যবহার করে, আর কোনো বড় সামরিক সংঘাত ঘটলে তা আরও বৃদ্ধি পাবে।
খালটির কৌশলগত গুরুত্ব
পানামা খাল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত জলপথ। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগকারী এই খাল দিয়ে বছরে হাজার হাজার বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজ চলাচল করে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট কন্টেইনার বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ এই খাল দিয়ে হয়ে থাকে। ফলে এর নিয়ন্ত্রণ যে কোনো দেশের জন্যই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
হেগসেথ তার বক্তব্যে দাবি করেন, খালটির অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এক ধরনের ‘গুপ্তচর ঝুঁকি’ তৈরি করছে। তার ভাষায়, “চীন এই খালে অবকাঠামো নির্মাণ এবং চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। এটি পানামার সার্বভৌমত্ব ও আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি।”
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগত অবস্থান
২০১৭ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পানামা খালকে পুনরায় আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। তার মতে, ১৯৯৯ সালে পানামার কাছে খাল হস্তান্তর করে যুক্তরাষ্ট্র বড় একটি ভুল করেছে। সেই নীতির ধারাবাহিকতায়ই এখন হেগসেথ এই ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও পানামার নেতা ওমর তোর্রিজের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে ধাপে ধাপে খালটির নিয়ন্ত্রণ পানামার হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চূড়ান্ত হস্তান্তরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ৮৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
চীনের প্রভাব ও গুপ্তচর আশঙ্কা
গত কয়েক দশকে চীন লাতিন আমেরিকায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। পানামার অবকাঠামো, বন্দর ও পরিবহন খাতে চীনা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। হেগসেথ বলেন, “চীনের উপস্থিতি মানে শুধু অর্থনৈতিক প্রভাব নয়, এর মাধ্যমে তারা তথ্য সংগ্রহ ও কৌশলগত নজরদারির সুযোগ পায়।” তিনি যুক্ত করেন, “আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করছি যেখানে নিরাপত্তা ও বাণিজ্য একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পানামা খালের উপর আমাদের নজর রাখা এখন সময়ের দাবি।”
পানামার প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক চাপ
হেগসেথের মন্তব্যের পর পানামা এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বিষয়টি নিয়ে দেশটির নীতিনির্ধারক মহলে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। পানামার অনেকেই মনে করেন, খালটি তাদের জাতীয় গর্ব ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক, যার ওপর কোনো বহিরাগত চাপ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
এদিকে, মাত্র দুই মাস আগেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও পানামা সফর করে দেশটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে খালের নিরাপত্তা ও চীনা সম্পৃক্ততা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। ওই সফরের পরই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, তাদের সরকারি জাহাজগুলো পানামা খাল ব্যবহার করলেও কোনো টোল দিতে হবে না। স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক্স (পূর্বে টুইটার)–এ এক পোস্টে জানায়, “এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্লেষকরা বলছেন, হেগসেথের বক্তব্য শুধু পানামা নয়, পুরো লাতিন আমেরিকার জন্যই উদ্বেগের বার্তা। কারণ, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত প্রভাব’ কৌশল অনেক দেশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের আশঙ্কা তৈরি করছে।
চীনের প্রতিক্রিয়াও অদূর ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা একদিকে যেমন লাতিন আমেরিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করছে, অন্যদিকে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কমানোর কৌশলগত প্রয়াস চালাচ্ছে।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
এই মুহূর্তে পানামা খাল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক ধরনের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কৌশলগত দিক বিবেচনায় এটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আন্তর্জাতিক আইন ও পানামার সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে কোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংঘাতের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে পানামা সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং চীনের প্রতিক্রিয়ার দিকে। একই সঙ্গে, এটি ট্রাম্প প্রশাসনের আগামী দিনের পররাষ্ট্র নীতির একটি ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে—বিশেষ করে যখন বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ ও শক্তির প্রদর্শনের সঙ্গে জড়িত।