ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে কি না, সিদ্ধান্ত মঙ্গলবার

ভোজ্যতেলের বাজারে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আগামী মঙ্গলবার। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও তাতে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
দাম বাড়ানোর প্রস্তাব
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি বিটিটিসি’র কাছে একটি চিঠির মাধ্যমে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৩ টাকা করে বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। তারা ১ এপ্রিল থেকে নতুন দাম কার্যকর করতে চেয়েছিল। তবে সরকারিভাবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
রেয়াত সুবিধার মেয়াদ শেষ
ভোজ্যতেল আমদানির ক্ষেত্রে পূর্বে যে শুল্ক ও কর রেয়াত সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তার মেয়াদ গত মার্চ মাসে শেষ হয়েছে। এ কারণেই কোম্পানিগুলো দাবি করছে, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে আগের দামে বাজারে পণ্য সরবরাহ করা তাদের জন্য আর সম্ভব নয়।
বৈঠকে উপস্থিত এক কারখানা প্রতিনিধির ভাষ্য, “আমরা চাই না দাম বাড়ুক। কিন্তু শুল্ক-কর রেয়াত না থাকলে আমাদের পক্ষে আগের দামে ভোজ্যতেল সরবরাহ করা অসম্ভব।”
এনবিআরের অনীহা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আশা করেছিল, রমজান মাসের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এনবিআর হয়তো শুল্ক-কর রেয়াত সুবিধা পুনরায় চালু করবে বা তার মেয়াদ বাড়াবে। এ লক্ষ্যে ট্যারিফ কমিশন গত মাসে একটি সুপারিশপত্রও এনবিআর বরাবর পাঠায়, যেখানে ৩০ জুন পর্যন্ত রেয়াতের মেয়াদ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে এনবিআর এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। ফলে বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এবং ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন।
বর্তমান বাজারদর
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৭৫ থেকে ১৭৬ টাকা এবং ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮৪৫ থেকে ৮৫০ টাকা। খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৫৭ থেকে ১৬৫ টাকা এবং খোলা পাম তেলের দাম ১৪৪ থেকে ১৫০ টাকা লিটারপ্রতি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন শুল্ক কাঠামো অনুযায়ী আমদানি করা তেলের উপর বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও কিছুটা মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, যা দেশে তার প্রভাব ফেলছে।
ট্যারিফ কমিশনের ভূমিকা
ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান বৈঠকে জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করছেন। তবে কমিশন চায়, ভোক্তা ও ব্যবসায়ী— উভয় পক্ষের স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে। দাম বাড়ানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও পর্যালোচনা প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।
ভোক্তা উদ্বেগ
ভোজ্যতেলের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে চাপ বাড়বে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। অনেকেই মনে করছেন, রমজান মাসে এমন সিদ্ধান্ত নিলে তা ন্যায্য হবে না।
রাজধানীর মিরপুরের এক বাসিন্দা বলেন, “প্রতিমাসে রান্নার খরচ এমনিতেই বেড়েছে। যদি আবার তেলের দাম বাড়ে, তাহলে আমাদের চলা খুব কঠিন হয়ে যাবে।”
বিকল্প সমাধানের আহ্বান
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, সরকার যেন ব্যবসায়ীদের যুক্তিগুলো খতিয়ে দেখে একটি বাস্তবভিত্তিক ও ভোক্তা-সমর্থনযোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দর বাড়লেও তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ না করে দাম বাড়ানো উচিত নয়।
বাংলাদেশ কনজিউমার রাইটস অর্গানাইজেশন (বিসিআরও)-এর সভাপতি জানান, “প্রতিবার দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে সামান্য মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দেশে অনেক বেশি দাম বাড়ানো হয়। আমরা চাই, সরকারের তদারকি আরও জোরালো হোক।”
আগামীর দৃষ্টিভঙ্গি
বর্তমানে দেশীয় বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাপে ভোজ্যতেলের মূল্য নিয়ে একটি সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একদিকে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের পক্ষে ভর্তুকি বা রেয়াত সুবিধা চালু রাখাও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার পুনরায় বৈঠক করবে। এতে যদি এনবিআরের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া আসে, তাহলে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পিছিয়ে যেতে পারে।
উপসংহার
ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হবে কি না, সেটি নির্ভর করছে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং এনবিআরের অবস্থানের উপর। তবে সাধারণ জনগণ ও বাজার বিশ্লেষকরা আশাবাদী যে, সরকার একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে, যা বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে।