অর্থনীতি

বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন ৫০ দেশের বিনিয়োগকারীরা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে রাজধানী ঢাকায় শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন। আগামীকাল সোমবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে শুরু হওয়া এই সম্মেলনে ৫০টি দেশের ৫৫০ জনেরও বেশি বিনিয়োগকারী, শিল্প উদ্যোক্তা ও বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহী প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।

এই বহুল প্রত্যাশিত ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’-এর আয়োজন করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বৈদেশিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব জোরদার করার লক্ষ্যে এই আয়োজনকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের বিনিয়োগ খাতে এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ।

‌বিশ্বের নজর এখন ঢাকায়

সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন করেছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জারা-এর মূল কোম্পানি ইন্ডিটেক্সের গ্রুপ সিইও অস্কার গার্সিয়া মাসেইরাস, এবং ডিপি ওয়ার্ল্ড গ্রুপ, দুবাই–এর চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলাইমান

এছাড়াও যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের সদস্য ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন, স্যামসাং-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সাং-জু লি, এবং জিওর্ডানো ইন্টারন্যাশনাল-এর সিইও কলিন মেলভিল কেনেডি কারিসহ আরো বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন।

বিডা সূত্র জানায়, অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় আছে মেটা (ফেসবুক), উবার, টেলিনর, টয়োটা-সহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বহু প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বি-ক্যাপিটাল, মালয়েশিয়া ও হংকংয়ের গোবি পার্টনার্স, কনজাংশন ক্যাপিটাল, মার্কো-এর মতো বড় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলোও উপস্থিত থাকবে।

‌অর্থনৈতিক অঞ্চলে সরাসরি পরিদর্শন

বিনিয়োগের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার অংশ হিসেবে এই সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিনিয়োগকারীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখানো হবে। প্রথম দিনেই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে চট্টগ্রামের আনোয়ারা কোরিয়ান ইপিজেড এবং মিরসরাইয়ের জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এনএসইজেড) পরিদর্শনে।

পরদিন মঙ্গলবার পরিদর্শন করা হবে নারায়ণগঞ্জের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল। মূলত যেসব বিনিয়োগকারী শিল্প স্থাপনের জন্য জমি খুঁজছেন, তাঁদের এই পরিদর্শন কার্যক্রমে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।


‌পুরস্কার, সম্মাননা ও নাগরিকত্ব

বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে সম্মেলনে পাঁচটি ভিন্ন শ্রেণিতে পুরস্কার দেওয়া হবে দেশি-বিদেশি সফল বিনিয়োগকারীদের। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করে আসা একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীকে সম্মাননা ও নাগরিকত্ব প্রদানেরও ঘোষণা দেওয়া হবে।

সম্মেলনের অংশ হিসেবে আয়োজিত স্টার্টআপ ও বাণিজ্য সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্কিং সেশনও হবে। এতে উদ্যোক্তারা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাবেন।


‌দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই মূল লক্ষ্য

রোববার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা সেই ধারণা পাল্টাতে চাই। আমরা দেখাতে চাই, বাংলাদেশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত, প্রতিযোগিতামূলক এবং ব্যবসাবান্ধব।’

তিনি আরও জানান, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ কতটা অনুকূল হবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে এই সম্মেলনে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সরাসরি এসে বাংলাদেশের সম্ভাবনাগুলো নিজ চোখে দেখার সুযোগ পাবেন।

‌যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক—বাধা নয়, বরং সুযোগ

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিষয়ে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না দেখে সম্ভাবনা হিসেবেই দেখছি।’ তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসটিআর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের কাস্টমস, ব্যবসা আইন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও আইটি রাইটস বিষয়ে কিছু প্রাথমিক সংস্কারের সুপারিশ এসেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিকল্পনায়ও রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশ নয়, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপরও শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে সবাই একই পরিস্থিতিতে রয়েছে। আমরা নিজেদের অবস্থান উন্নত করে এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।’

এ সময় তিনি জানান, বিনিয়োগ সম্মেলনের এক পর্যায়ে ন্যাসা (NASA)-এর সঙ্গে একটি বেসামরিক চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-র সঙ্গে শ্রম আইন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হতে পারে।

‌জ্বালানি সংকট নিয়ে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি

নতুন বিনিয়োগকারীদের অন্যতম চিন্তার জায়গা—দেশে জ্বালানির সরবরাহ ঘাটতি। এ বিষয়ে আশিক চৌধুরী জানান, ‘আমরা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জ্বালানি রপ্তানি নিয়ে আলোচনা করেছি। যদি এটি কার্যকর হয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমবে এবং দেশের বিদ্যমান জ্বালানি সংকট অনেকটাই প্রশমিত হবে।’

‌উপস্থিত ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যক্তিরা

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিডা চেয়ারম্যান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, ও বিডার পরিচালক অপূর্ব জাহাঙ্গীর

সম্মেলন ঘিরে সরকার, ব্যবসায়িক মহল ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও আশাবাদ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের এই প্রয়াস যে দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button