চীনের শূন্য-শুল্ক সুবিধা নিতে পারছে না বাংলাদেশ

চীনের দেওয়া শূন্য-শুল্ক বাণিজ্য সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশ তার পুরোপুরি সুফল নিতে পারছে না। মূলত পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাব এবং নির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভরতার কারণে এই সুযোগ সীমিত হচ্ছে। অপরদিকে, চীন থেকে আমদানির হার ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বাংলাদেশের চীনের ওপর নির্ভরতা আরও বেড়ে চলেছে।
বাণিজ্যে ভারসাম্যের অভাব
চীন বহু বছর ধরে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। তবে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি ব্যবধান বিশাল। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ চীন থেকে ৮.৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যেখানে একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ৪৬১.০৫ মিলিয়ন ডলার।
গত অর্থবছরেও এই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি ১৬.৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, কিন্তু রপ্তানি ছিল মাত্র ৭১৫.৩৭ মিলিয়ন ডলার।
আমদানি বৃদ্ধির কারণ
বাংলাদেশের আমদানির একটি বড় অংশ চীনের তৈরি সুতা ও কাপড়ের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষত কৃত্রিম সুতা ও কাপড়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে চীনের ওপর নির্ভর করে। এছাড়াও আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি, তুলা, খাদ্যপণ্য এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্য অন্তর্ভুক্ত।
রপ্তানির সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হলো তৈরি পোশাক, যা চীনে খুব বেশি প্রতিযোগিতামূলক নয়। চীন নিজেই বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, যার বৈশ্বিক বাজারে অংশীদারিত্ব ৩১ শতাংশেরও বেশি। চীনের পোশাক খাতের বাজারমূল্য প্রায় ৭৫০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের সমান।
তবে চীন প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করে। এই বাজারের একটি অংশ বাংলাদেশ দখল করতে পারলেও রপ্তানি সীমিত থাকার মূল কারণ হলো পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাব।
চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রয়োজন
অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের মতে, বাংলাদেশের উচিত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য পুনর্গঠনের জন্য চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান সমস্যা হলো কৃত্রিম সুতা ও টেক্সটাইল খাতের দুর্বলতা। এ খাতে চীনা বিনিয়োগ আনতে পারলে চীনে রপ্তানি বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।”
তিনি আরও বলেন, “চীনের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী করা উচিত। বিশেষ করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, সোলার প্যানেল, সেমিকন্ডাক্টর ও মাইক্রোচিপ উৎপাদনে বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ রয়েছে।”
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির গুরুত্ব
বর্তমানে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা চলছে। এ প্রসঙ্গে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “এই চুক্তিকে শুধু মুক্ত বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তি হিসেবে পুনর্গঠন করা দরকার। এতে উভয় দেশ লাভবান হবে।”
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন জানান, “ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে চীনের ব্যবসায়ীরা নতুন বাজারের সন্ধানে ছিল। তখন থেকেই অনেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।”
চীনা বাজারে পণ্য বৈচিত্র্যের সুযোগ
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রশাসক হোসেন বলেন, “চীনের আমদানিকারকরা কাঁঠাল, আম, পেয়ারা ও ইলিশ মাছের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারে।”
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল চীনা কারখানাগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তরের আহ্বান জানান। এছাড়াও তিনি চীনের বৃহৎ ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশে শাখা খোলার পরামর্শ দেন, যা অর্থায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা
চাইনিজ এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশের (সিইএবি) তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনটির এক হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত সদস্য রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে পোশাক ও বস্ত্র কারখানায় বিনিয়োগ করেছে।
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম জানান, “চীনে রপ্তানি বৃদ্ধির প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বৈচিত্র্যময় পণ্যের অভাব। চীনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে আসেন, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে তারা বিনিয়োগে পিছিয়ে যান।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকালে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের নতুন চীনা বিনিয়োগ পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন চুক্তি এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করতে পারে। তবে এর জন্য সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যা বিনিয়োগবান্ধব নীতির মাধ্যমে চীনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করবে।