বানিজ্য

কুমিল্লার ঈদ বাজারে খাদির রাজত্ব

ঈদ মানেই নতুন পোশাকের উৎসব। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মতো কুমিল্লার ঈদ বাজারেও পোশাকের ব্যাপক চাহিদা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে এবার বিশেষভাবে নজর কেড়েছে খাদি কাপড়ের পোশাক। কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, শাড়ি ও ফতুয়া ক্রেতাদের মন কেড়ে নিচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী এই কাপড়ের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা ও ভালোবাসার কারণে ঈদের বাজারে খাদির দাপট স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

ঐতিহ্যের ধারায় খাদির জনপ্রিয়তা

কুমিল্লার খাদি পোশাকের সুখ্যাতি দেশজুড়ে। কুমিল্লা শহরে খাদির নাম সংযুক্ত দোকানের সংখ্যা চার শতাধিক। রাজগঞ্জ বাজারের পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু করে কান্দিরপাড়ের রামঘাটলা পর্যন্ত এসব দোকান ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া নগরীর রাজবাড়ি এলাকায় রয়েছে খাদি বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট মার্কেট ‘হিলটন টাওয়ার’। এই অঞ্চল থেকেই খাদির কাপড় বিচ্ছিন্নভাবে রপ্তানি হচ্ছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কুমিল্লার খাদি শিল্পে বর্তমানে দেড় হাজারেরও বেশি পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।

খাদির ইতিহাস শতবছরের পুরনো। স্বদেশি আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধী যখন বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক দেন, তখন থেকেই খাদির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। খাদির কাপড় একসময় কুমিল্লার গর্ব হিসেবে বিবেচিত হতো। বড় বড় রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা খাদির পাঞ্জাবি, চাদর ও পায়জামা পরতে গর্ববোধ করতেন। কালের বিবর্তনে খাদির চাহিদা কিছুটা কমে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে খাদির নতুন ডিজাইন ও মানোন্নয়নের ফলে তা আবারও বাজার দখল করতে শুরু করেছে।

বাজারে খাদি পোশাকের মূল্য ও চাহিদা

কুমিল্লার খাদির বাজারে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন ডিজাইন ও দামের মধ্যে খাদির পাঞ্জাবি, শাড়ি, ফতুয়া, থ্রি-পিস, বিছানার চাদর ও বালিশের কভার ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে,

  • খাদি পাঞ্জাবির দাম: ৪০০ থেকে ১৪০০ টাকা,
  • খাদি শার্টের দাম: ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা,
  • খাদি থ্রি-পিসের দাম: ৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা,
  • খাদি শাড়ির দাম: ৭৫০ থেকে ১৮০০ টাকা।

সাধারণত বাজারে অন্যান্য পোশাকের দাম বাড়লেও খাদির পোশাকের দাম খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এর অন্যতম কারণ হলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়া এবং খাদি প্রস্তুতকারকদের ব্যবসায়িক নীতি। তাছাড়া খাদির কাপড়ের মান ভালো হওয়ায় এবং রঙ দ্রুত নষ্ট না হওয়ার কারণে ক্রেতারা এটি বেশি পছন্দ করছেন।

ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়া

খাদির প্রতি ক্রেতাদের ভালোবাসা ও চাহিদার কথা জানালেন আমেরিকা প্রবাসী মঞ্জুর মোরশেদ। তিনি এবার ঈদ উপলক্ষে দেশে এসেছেন পরিবারের সঙ্গে উৎসব উদযাপন করতে। পরিবারের জন্য খাদির পোশাক কিনতে তিনি বাজারে আসেন এবং তার শ্বশুরকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন, যিনি ভারতের হায়দরাবাদ থেকে প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছেন।

তিনি বলেন, “বাবার সাথে একসময় খাদি কাপড় কিনতাম, এখন নিজে এলাম পরিবারের জন্য পোশাক কিনতে। শ্বশুরও এখানকার খাদির গুণগত মান দেখে প্রশংসা করেছেন।”

গৃহিণী তানজিনা ইসলাম বলেন, “খাদির কাপড়ের রঙ দীর্ঘস্থায়ী, দামও তুলনামূলকভাবে কম এবং টেকসই। তাই বাবা ও পরিবারের জন্য খাদির পাঞ্জাবি কিনতে এসেছি।”

ময়নামতি থেকে আসা ক্রেতা গিয়াস উদ্দিন জানান, “ঈদ উৎসবে খাদির পোশাক পরলে শেকড়ের টান অনুভব করি। এবার নিজের জন্য পাঞ্জাবি এবং পরিবারের জন্য থ্রি-পিস কিনেছি।”

ব্যবসায়ীদের অভিমত

খাদিঘরের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, “আমরা খাদির মান নিয়ে কখনও আপস করি না। তাই আমাদের কাপড়ের রঙ পাকা থাকে এবং দামও সাশ্রয়ী। ১৯২১ সালের প্রেক্ষাপট ও বর্তমান চাহিদা এক নয়, তাই আমরা ডিজাইনের নতুনত্ব আনতে কাজ করছি।”

খাদির ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে ডিজাইনে আধুনিকতার সংযোজনের ফলে তরুণদের মধ্যেও খাদির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের তুলনায় খাদি কাপড়ে কারুকাজ ও নকশার বৈচিত্র্য এসেছে। ফলে তরুণ প্রজন্ম খাদির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

ভবিষ্যত সম্ভাবনা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খাদি কাপড়ের বাজার আরও প্রসারিত করার জন্য ডিজাইন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।

কুমিল্লার খাদি শিল্প যদি সঠিক পরিকল্পনা ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এগিয়ে যায়, তাহলে এটি শুধু স্থানীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও আরও ব্যাপকভাবে স্থান করে নিতে পারবে। কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড় বিশ্বের দরবারে ব্র্যান্ডিং করার এখনই উপযুক্ত সময়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button