এবার মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিষিদ্ধ হচ্ছে ডিপসিক

চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল ‘ডিপসিক’কে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের সরকারি ডিভাইসে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা
সাম্প্রতিক সপ্তাহে কর্মীদের উদ্দেশে পাঠানো এক অভ্যন্তরীণ মেইলে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘‘তথ্য ব্যবস্থা নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের সরকারি ডিভাইসে নতুন চীনা এআই কোম্পানি ডিপসিকের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।’’
মেইলে আরও বলা হয়েছে, ‘‘ডিপসিক ব্যবহার করে কোনো ধরনের অ্যাপ্লিকেশন, ডেস্কটপ অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ডাউনলোড করবেন না বা দেখবেন না। এমনকি ডিপসিকের মাধ্যমে কোনো লিংকেও প্রবেশ করা যাবে না।’’
মার্কিন সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য চেয়েও সাড়া পায়নি। এছাড়া, নিষেধাজ্ঞার প্রকৃত পরিসর সম্পর্কেও বিস্তারিত জানা যায়নি।
ডিপসিকের উত্থান ও বিতর্ক
চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিপসিক ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে। তখন থেকেই এটি মার্কিন প্রযুক্তি বাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অ্যাপল স্টোরে ফ্রি অ্যাপের তালিকায় ডিপসিক ছিল সর্বাধিক ডাউনলোড হওয়া অ্যাপগুলোর একটি। এর সাশ্রয়ী মূল্যের এআই মডেল প্রযুক্তিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করেছিল।
তবে, মার্কিন কর্মকর্তা ও কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে শুরু থেকেই ডিপসিকের ডেটা প্রাইভেসি ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ ছিল। তারা দাবি করেন, এই এআই মডেল ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মার্কিন কংগ্রেসের পদক্ষেপ
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের ‘হাউস পার্মানেন্ট সিলেক্ট কমিটি অন ইন্টেলিজেন্স’-এর সদস্য কংগ্রেসম্যান জশ গোথাইমার ও ড্যারিন লাহুড সরকারি ডিভাইসে ডিপসিক নিষিদ্ধের জন্য আইন প্রণয়ন করেন।
এ মাসের শুরুতে মার্কিন গভর্নরদের উদ্দেশে পাঠানো এক চিঠিতে এই দুই কংগ্রেসম্যান সরকারি বিভিন্ন টুলে চীনা এআই অ্যাপ নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান। ৩ মার্চ পাঠানো ওই চিঠিতে তারা উল্লেখ করেন, ‘‘ডিপসিক ব্যবহার করে নিজেদের অজান্তেই ব্যবহারকারীরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সঙ্গে সংবেদনশীল ও মালিকানাধীন তথ্য যেমন চুক্তি, নথি ও আর্থিক রেকর্ড শেয়ার করছেন।’’
অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা
যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য এরই মধ্যে সরকারি ডিভাইসে ডিপসিকের এআই মডেল নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভার্জিনিয়া, টেক্সাস ও নিউ ইয়র্ক। এছাড়া, ২১টি অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলের একটি জোট কংগ্রেসকে এ নিয়ে কঠোর আইন পাস করার আহ্বান জানিয়েছে।
চীনের প্রতিক্রিয়া
এ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এখন পর্যন্ত চীনের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে, এর আগে বিভিন্ন মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছিল বেইজিং।
জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীনা প্রযুক্তির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই কঠোর অবস্থান আসলে দুই দেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতারই প্রতিফলন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াশিংটন হুয়াওয়ে, টিকটকের মতো চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যা বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান চীনা সরকারের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং তারা মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে পারে। তবে, চীন বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
ভবিষ্যৎ প্রভাব
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই নিষেধাজ্ঞা ডিপসিকের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কার্যক্রম চালানোর সম্ভাবনাকে কঠিন করে তুলবে। পাশাপাশি, এটি মার্কিন প্রশাসনের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হিসেবে কাজ করবে।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রযুক্তি ও বাণিজ্য সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, যদি চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে, তবে বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতে অস্থিরতা বাড়তে পারে।