বিশ্ব

সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবি ঘিরে অশান্ত নাগপুর

মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিকে কেন্দ্র করে মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহরে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতার ফলে প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে। সহিংসতার অভিযোগে সোমবার রাতে পুলিশ ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

ঘটনার সূত্রপাত

এই পরিস্থিতির সূচনা হয় সম্ভাজি নগরকে কেন্দ্র করে, যার আগের নাম ছিল আওরঙ্গবাদ। বর্তমানে এটি মহারাষ্ট্রের যোদ্ধা রাজা ছত্রপতি শিবাজির পুত্র সম্ভাজির নামে রাখা হয়েছে। সেখানকার খুলদাবাদ এলাকাতেই মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এই সমাধি সরানোর দাবি জানিয়ে আসছিল। সম্প্রতি এই দাবি নতুন করে জোরদার হয়েছে।

সোমবার নাগপুর শহরের মহল অঞ্চলে আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবিতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর বেশ কয়েকটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে আওরঙ্গজেবের একটি ছবি এবং সবুজ কাপড়ে ঢাকা এক প্রতীকী কবরে আগুন লাগিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়।

সহিংসতার সূত্রপাত

এই অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর শহরের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা যানবাহন ও দোকানে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এমনকি পুলিশও আক্রান্ত হয়। সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন পুলিশ সদস্য এবং বেশ কয়েকজন সাধারণ নাগরিক আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।

নাগপুরের পুলিশ কমিশনার রবীন্দ্র সিংঘল জানিয়েছেন, শহরের মোট ১১টি থানা এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে সম্ভাজি মহারাজের মৃত্যু হয়েছিল। সম্প্রতি ‘ছাওয়া’ নামে এক হিন্দি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যেখানে আওরঙ্গজেবের চরিত্রায়ণ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো সমাধি সরানোর দাবিকে আরও জোরালো করে। তারা সমাধিক্ষেত্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেয় এবং খুলদাবাদ অভিযানের ডাক দেয়।

তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় জেলা প্রশাসন গত শনিবার থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। নাগপুর শহরের বিক্ষোভ মিছিল সেই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেই আয়োজন করা হয়েছিল। বজরঙ্গ দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদও সেই আন্দোলনের সমর্থন জানিয়েছে।

মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান

মহারাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং তার দুই জোটসঙ্গী দল এই ঘটনায় বিভক্ত। মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনবিশ, যিনি নাগপুরের বাসিন্দা, নাগরিকদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘নাগপুর শান্তির জায়গা। জনগণ যেন পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘এই অশান্তির পেছনে গভীর চক্রান্ত রয়েছে।’’

অন্যদিকে, এনডিএ সরকারের শরিক রিপাবলিকান পার্টি হিন্দুত্ববাদীদের দাবির বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, ‘‘আওরঙ্গজেব ইতিহাসের একটি চরিত্র। তাঁর সমাধি সরানোর দাবি ইতিহাসকে বিকৃত করার শামিল।’’ কংগ্রেসও একই সুরে বলেছে, ‘‘মারাঠাভূমিতে আওরঙ্গজেব পরাস্ত হয়েছিলেন, এটাই ইতিহাস। তাই তাঁর সমাধিও এখানেই থাকা উচিত।’’

তবে সম্ভাজি নগরের শিব সেনা (শিন্ডে গোষ্ঠী) আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতি

সহিংসতার কারণে নাগপুর শহরের পরিস্থিতি থমথমে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে। প্রশাসন জানিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ বহাল থাকবে।

উপসংহার

আওরঙ্গজেবের সমাধি সরানোর দাবি নতুন কিছু নয়, তবে সাম্প্রতিক ঘটনায় নাগপুরসহ মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র হয়েছে। প্রশাসন শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button